You dont have javascript enabled! Please enable it!

নিউজউইক -Poet of Politics | রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু- ৫ এপ্রিল ১৯৭১

গত সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তখন তার সমালোচকেরা বলতে শুরু করলো, মুজিব তাঁর চরমপন্থি সমর্থকদের চাপে এই ঘোষণা দিয়েছেন। স্রোতে ডুবে যাওয়ার বদলে স্রোতের টানে চলার কৌশল নিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুজিবের উত্থান হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙালি জাতির একজন নেতা হিসেবে। জাতীয়তাবাদের জন্য বাঙালিরা যৌক্তিক লড়াই করে যাচ্ছিলো দীর্ঘদিন ধরে। যদিও বা মনে হতে পারে মুজিব স্রোতের টানে চলছেন, কিন্তু আদতে তার উত্থান কাকতালীয় নয়। ৫১ বছর আগে ঢাকার নিকটবর্তী একটি গ্রামে একজন স্বচ্ছল কৃষকের ঘরে জন্ম নেওয়া মুজিব বিরাট কোন শিক্ষাগত অর্জন ছাড়াই লেখাপড়া শেষ করেন। সময়ের সাথে সাথে তিনি একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতায় পরিণত হলেন। মানুষের সাথে কথা বলতে পছন্দ করতেন। চলনে বলনে খেলাধুলায় তিনি সময়ের সাথে হয়ে উঠলেন অসামান্য। কলকাতার ইসলামিক কলেজে যখন তিনি লিবারেল আর্টস ডিগ্রীর জন্য পড়াশুনা করতে গেলেন তখন সেখানকার মুসলিম লীগের কিছু জ্যেষ্ঠ নেতাকর্মীর নজরে আসেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন তখন এইচ এস সোহরাওয়ার্দী, যিনি ব্রিটিশরাজের অধীনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক বছর দায়িত্ব পালন করেন। মুজিব আইন বিষয়েও পড়াশুনা করেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী মধ্যপন্থী হওয়ায়  মুজিব তার পদাঙ্ক অনুসরণ না করে সরাসরি পদক্ষেপের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চল্লিশ দশকের শেষ দিকে তাঁরা দুজনেই অনুধাবন করলেন যে, নব গঠিত পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান প্রদেশ বাংলাকে নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী সুসংগঠিত “বাংলার বাঙালিদের জন্য” আওয়ামী লীগ নামের নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। মুজিব রাজপথে নেমে গেলেন এবং অবৈধ হরতাল এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অপরাধে তাকে দুইবার গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হলো।

জেল হতে বের হয়েই মুজিব হয়ে গেলেন আওয়ামী লীগে। একসময় সোহরাওয়ার্দীর ডান-হাতে পরিণত হলেন। কিন্তু অন্যান্য দলের সাথে জোট গঠন হওয়ায় তার নেতৃত্ব দেবার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়া হলো। তবে ১৯৫৬ সালে মুজিব সাফল্যের সাথে পূর্ব-পাকিস্তানে নবগঠিত আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সাত মাস কৃতিত্বের সাথে তিনি শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর মুজিব অনেকটা বিনা বাঁধায় তাঁর কিছু পুরানো আদর্শিক রীতিনীতিতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন। রাজনীতিতে যুক্ত করেন “স্বতস্ফুর্ততার” শৈলী এবং আভ্যন্তরীন নিজস্ব শাসন ব্যবস্থার দাবী করেন। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে. ১৯৬৬ সালে আইয়ুব খান সরকার তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে। পূর্ব-পাকিস্তানে তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো। ফলস্রুতিতে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। জনগণের চোখে মুজিব জাতির নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন ।

একজন গড়পড়তা বাঙালির তুলনায় লম্বা (তাঁর উচ্চতা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি), চুলে রুপালী আভা, পুরু গোঁফ এবং কালো চোখের অধিকারী মুজিব খুব সহজেই লাখো মানুষের হৃদয় আকর্ষণ করলেন। তাঁর উদ্দীপ্ত ভাষণের মাধ্যমে জনগণকে আপ্লুত করার অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর। একজন কূটনৈতিকের মতে – “তুমি তাঁর সাথে একা আলাদাভাবে কথা বললেও তাই হবে এবং তিনি এমনভাবে কথা বলেন মনে হবে তিনি ৬০ হাজার মানুষের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন।” একাধারে উর্দু, বাংলা এবং ইংরেজী – পাকিস্তানের এই তিন ভাষায় তিনি সমান পারদর্শী। মুজিবের মাঝে চিন্তাবিদ হবার ভান নেই, তিনি প্রকৌশলী নন, বরং তিনি রাজনীতির কবি। কিন্তু সচরাচর বাঙালিরা কৌশলী নয়, বরং কিছুটা চিন্তক, এবং সেজন্যই হয়তো তাঁর রাজনৈতিক কৌশলই দরকার ছিল সকল অঞ্চলের ভিন্ন মতাদর্শ এবং নানা শ্রেণীর মানুষকে একত্রীকরণের জন্য।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!