You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিবাহিনী

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাত বাঙালি জাতির জীবনের এক কালরাত। এ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বড়-বড় শহরে একযোগে আক্রমণ করে বাঙালি সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। তারা ঢাকা শহরের পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত করে বর্বরোচিত ও নজিরবিহীন গণহত্যা। এ আক্রমণের পরপরই বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ ছাত্র-জনতা সম্মিলিতভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকা শহর যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংক আর কামানের গোলার আঘাতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে, তখন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- তাঁর সহকর্মীদের নিরাপদ স্থানে গমন করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। রাত ১২টার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা বার্তাটি পিলখানা ইপিআর-এর ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে প্রেরণ করা হয়। ঐ বার্তায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাবার বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছিল। উল্লেখ্য, এর পূর্বে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ এক ঐতিহাসিক ভাষণে দেশকে মুক্ত করতে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে বাঙালি জাতির প্রতি ‘ঘরে ঘরে দুর্গ’ গড়ে তোলা এবং ‘যার যা কিছু আছে’ তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সর্বত্র বাঙালিরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই দেশের সর্বত্র সামরিক বাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্য, আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র-জনতা পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী।
রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীনে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সুসংগঠিত ও সমন্বিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি সরকার গঠন করা হয়, যা মুজিবনগর সরকার- নামে সর্বাধিক পরিচিত। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার। একই দিন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণ বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেন। এরপর ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা)-র বৈদ্যনাথতলায় (মুজিবনগর) বিদেশী সাংবাদিক ও কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে এ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১০ই এপ্রিল সরকার গঠনের পরপর কর্নেল এম এ জি ওসমানী-কে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। এ সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করে। সরকারের সদর দপ্তর ছিল কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। সেনা, নৌ, বিমান, আনসার, পুলিশ, ইপিআর, পুলিশ, পেশাদার/নিয়মিত আনসার, মুজাহিদ ইত্যাদি বাহিনী, বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক তথা সর্বস্তরের জনতাকে নিয়ে গঠিত গণবাহিনী, গেরিলা যোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক এবং স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বাহিনী প্রভৃতি মুক্তিবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পেশাদার/নিয়মিত বাহিনী: মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকার প্রথমে সমগ্র দেশকে ৮টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে ৮ জন কমান্ডার নিয়োগ করে। এরপর ১২-১৭ই জুলাই বাংলাদেশ সরকার-এর সদর দপ্তর কলকাতার থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারদের এক সভায় দীর্ঘ আলোচনা শেষে বাংলাদেশকে মোট ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। যুদ্ধের সুবিধার্থে প্রতিটি সেক্টর (১০নং সেক্টর ব্যতীত)-কে কয়েকটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। এসব সেক্টর/সাব-সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছাড়াও গেরিলা ও গণবাহিনীর সদস্যরা ছিলেন (দ্রষ্ট্রব্য মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন- উল্লেখযোগ্য।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে মোট ১৩১ জন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের মূর্তি অফিসার প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে প্রথম বাংলাদেশ শর্ট সার্ভিস কোর্সের ৫৮ জন নবীন অফিসার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে নিয়মিত বাহিনীর মোট সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার ২শ ৫৬ জন।
মুক্তিযুদ্ধকে আরো বেগবান করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের পরিকল্পনা করেন এবং এ লক্ষ্যে মে মাসের ৩য় সপ্তাহ থেকেই কার্যক্রম শুরু করা হয়। জুলাই মাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের সমন্বয়ে ৩টি নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং অন্যান্য আর্মস ও সার্ভিসের বাঙালি সেনাসদস্যদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১, ২, ৩, ৪, ৮, ৯, ১০ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সংগঠিত করা হয়। বাঙালি ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য এবং ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে এসব রেজিমেন্টের সৈনিক ঘাটতি পূরণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ২, ৪ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যথাক্রমে মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম, মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম ও মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। এ ৩ জন বাঙালি জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে ‘কে’ ফোর্স, ‘এস’ ফোর্স ও ‘জেড’ ফোর্স নামে ৩টি ব্রিগেড গঠন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্ট প্রদানের জন্য গোলন্দাজ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এজন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদেয়া ৮০ জন বাঙালি গোলন্দাজ সদস্য এবং কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গোলন্দাজ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এরপর ১২ই জুলাই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কোনাবনে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এ বাহিনীর নাম দেয়া হয় মুজিব ব্যাটারি। প্রাথমিক অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময ব্যবহৃত ফ্রান্সের তৈরি ৩ ফুট ৭ ইঞ্চি ৬টি কামান এ রেজিমেন্টের জন্য পাওয়া যায়। এ আর্টিলারি বাহিনী মেজর খালেদ মোশাররফের ‘কে’ ফোর্সের অধীনে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে এ নতুন রেজিমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে (দ্রষ্টব্য মুজিব ব্যাটারি)।
মুক্তিযুদ্ধকালে বেশ কয়েকজন বাঙালি পাইলট ও টেকনিশিয়ান পাকিস্তান বিমানবাহিনী ও পিআইএ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত স্থল বাহিনীর সঙ্গেই যুদ্ধ করেন। তাঁদের মধ্যে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মোট ৩৫ জন বাঙালি কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্থল আক্রমণের পাশাপাশি বিমান আক্রমণ পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ সরকার বিমান বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৭১ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের যোধপুরের মহারাজা প্রদত্ত আমেরিকার তৈরি একটি পুরে ডিসি-৩ (ডাকোটা), কানাডার তৈরি একটি ডিএইচসি- অটার বিমান ও ফ্রান্সের তৈরি একটি অ্যালুয়েট-I হেলিকপটার নিয়ে ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের এক পরিত্যক্ত রানওয়েতে বাঙালি পাইলট ও টেকনিশিয়ানদে সমন্বয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদে বিমান বাহিনী গঠন করা হয়, যার নামকরণ করা হয় ‘কিলো ফ্লাইট’। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে বিত্তি অভিযান পরিচালনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বি পরিমাণ ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হয় এবং এর ফে মুক্তিযুদ্ধের সফলতা ত্বরান্বিত হয়।
একইভাবে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক দেশের সমুদ্র ও নদীবন্দরসহ সমগ্র সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা ও অভ্যন্তরীণ জলপথে কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে ১৯৭১ সালের ১৩ই মে গঠন করা হয় নৌকমান্ডো বাহিনী। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে (এ সেক্টরের কোনো সীমানা নির্ধারিত ছিল না, দেশের সমস্ত জলসীমা এ সেক্টরের আওতাভুক্ত ছিল) ১৫ই আগস্ট থেকে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত অপারেশন জ্যাকপট-এর আওতায় চট্টগ্রাম, মংলা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন নৌ ও সমুদ্রবন্দর এবং ফেরিঘাটে অভিযান পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে তোলেন।
জলপথে পাকিস্তানি নৌবাহিনীসহ পাকিস্তানি ও বিদেশী জাহাজের অবাধ চলাচল প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৭১ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করা হয় ভারত সরকার প্রদত্ত রণতরি ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’। বাংলাদেশ নৌবাহিনী চট্টগ্রাম, চালনা সমুদ্রবন্দর ও হিরণ পয়েন্টে অভিযান পরিচালনা করে পাকিস্তানি ও বিদেশী জাহাজের ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হয় এবং এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়।
গণবাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি হাজার-হাজার ছাত্র-যুবক ও সব শ্রেণি- পেশার মানুষকে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীতে গণবাহিনী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এঁদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য সীমান্তবর্তী এলাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ১১০টি অভ্যর্থনা শিবিরেও বাংলাদেশের এসকল ছাত্র ও যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে এ বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৫শ জন।
বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে প্রায় ১০ হাজার গেরিলা যোদ্ধার সম্বয়ে বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) বা মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রলীগ-এর সাবেক নেতৃবৃন্দ। এ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল জাফলং ও ভারতের তান্দুয়ায়। সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি যথা পূর্ব, উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রশিক্ষিত ছাত্র ও যুবকদের নির্ধারিত এলাকায় প্রেরণ করা হতো। এ ৪টি অঞ্চলের মূল নেতৃত্বে ছিলেন- শেখ ফজলুল হক মণি (পূর্ব অঞ্চল), সিরাজুল আলম খান (উত্তর অঞ্চল), আবদুর রাজ্জাক (পশ্চিম অঞ্চল) এবং তোফায়েল আহমেদ (দক্ষিণ অঞ্চল)। বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা এ-সকল নেতৃবৃন্দের তত্ত্বাবধানে তাঁদের অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করতেন (দ্রষ্টব্য মুজিব বাহিনী)।
ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন বাহিনী: মোহাম্মদ ফরহাদ ও চৌধুরী হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে ন্যাপ-, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর ছাত্র ও যুবকদের সমন্বয়ে আরো একটি গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়েছিল। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের মতো।
স্থানীয় বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে নিয়মিত বাহিনী, মুজিব বাহিনী ও গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি মুক্তিবাহিনী স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠে। এসব বাহিনীর মধ্যে কাদেরিয়া বাহিনী- (টাঙ্গাইল; মোট সদস্য ১৭ হাজার; স্বেচ্ছাসেবক ৬০ হাজার), বাতেন বাহিনী- (টাঙ্গাইল; সদস্য সংখ্যা ৫ হাজার), হেমায়েত বাহিনী- (বৃহত্তর ফরিদপুর; সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮০০০), -লুৎফর বাহিনী- (ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর; সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫০০), পাঠান বাহিনী- (হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর; সদস্য সংখ্যা ৩শ), রফিক বাহিনী (বাগেরহাট; সদস্য সংখ্যা ৪শ), পলাশডাঙ্গা যুব শিবির- (সিরাজগঞ্জ; সদস্য সংখ্যা ৫শ), অহিদুর বাহিনী- (আত্রাই; সদস্য সংখ্যা ১ হাজার যোদ্ধা ও ১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক), আফতাব বাহিনী (কুড়িগ্রাম; সদস্য সংখ্যা ৫শ যোদ্ধা ও ৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবক), জিয়া বাহিনী- (সুন্দরবন; সদস্য সংখ্যা ১৬ হাজার), সিদ্দিক বাহিনী (ভোলা), মান্নান ভূঁইয়া বাহিনী (নরসিংদী), আফসার বাহিনী (ভালুকা, ময়মনসিংহ; সদস্য সংখ্যা ৪ হাজার ৫শ), আকবর বাহিনী (মাগুরা; সদস্য সংখ্যা ১১শ ২৮ জন) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় এসব বাহিনী শত্রুর বিরুদ্ধে এম্বুশ, গেরিলা অপারেশন, কখনো সম্মুখ যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ফরিদপুর অঞ্চলের হেমায়েত বাহিনী, সিরাজগঞ্জের আবদুল লতিফ মীর্জার নেতৃত্বাধীন পলাশডাঙ্গা যুব শিবির, কুড়িগ্রামের আফতাব বাহিনী, ভালুকার আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন আফসার বাহিনীর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শত্রুর অস্ত্র ও থানা লুট বা দখল করে প্রাপ্ত অগ্নেয়াস্ত্র ছিল তাঁদের অস্ত্রের উৎস। এঁদের কেউ-কেউ বহু এলাকা হানাদারমুক্ত রাখতে সক্ষম হন। এঁরা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়াও তাদের এ দেশীয় দালালরাজাকারদের বিরুদ্ধে নানা অপারেশন পরিচালনা করে তাদের হত্যা, গ্রেপ্তার বা দমন করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনেন।
এভাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী সমগ্র দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম, আন্তরিক প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী নিয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ-এর। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির ও হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!