You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন জ্যাকপট
যুগ যুগ ধরে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে বাংলার প্রতিটি অঞ্চল পরিচিত হয়েছে সংগ্রামী জনপদে। বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যের সাথে সংযােজিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ঐতিহ্য। বীরবাঙালি বর্বর পাকহানাদারদের সাথে লড়ছে বুদ্ধির কৌশলে। সশস্ত্র বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বীরবাঙালির মুক্তিযােদ্ধা বিশ্বের ইতিহাসে স্থাপন করেছে অনন্য নজির। বাংলা মায়ের সূর্য সন্তানেরা বর্বরদের বিরুদ্ধে লড়ছে জলে, স্থলে। পাকবর্বরেরা যখন স্থলে বীরবাঙালিদের মুখােমুখি হচ্ছে ঠিক তখনই মুক্তির সৈনিকরা জলপথে পাকবাহিনীকে আক্রমন করে বিশ্বকে থমকে দিয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেদিন দেশীয় কুচক্রী ও বিদেশী ইংরেজ বেনিয়ারা বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে অস্তমিত করেছিল হিংস্রতা দিয়ে। ২১৪ বছর পর আবার বৃটিশ বেনিয়াদের মতাে হিংস্রতা নিয়ে বাংলার মাটিতে আবির্ভূত হল পাকিস্তানী বর্বরের দল। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে মীর জাফর,জগৎ শেঠের প্রেতাত্মা গােলাম আজম, নূরুল আমিন, আব্বাস আলী খানরা। তারা এদেশে ইসলামের মুখােশ পরে গড়ে তুলছে আল বদর, আল শামস, রাজাকার বাহিনী। এসব কুলাঙ্গারদের শিক্ষা দিতে বাংলার সুযােগ্য সাহসী সন্তানেরা পথে নেমেছে হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। প্রতিজ্ঞা করেছে পাক বর্বরদের জলে, স্থলে সর্বত্রই আঘাত হানতে হবে। তাদের পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে দিতেই হবে।
ভারতের মুর্শিদাবাদের সবুজ মাঠ গ্রামগুলাে ছবির মতাে। পলাশীর প্রান্তরে পলাশী যুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ মনুমেন্ট। লেখা রয়েছে ব্যাটল ফিলড অব পলাশী। মনুমেন্টের গােড়ায় শ্বেত পাথরে লেখা এই সেই পলাশী’ ইত্যাদি। মনুমেন্টর দক্ষিণ পাশে ঘন আমের বাগান—ঐতিহাসিক আম্রকানন। আমবাগানের পূর্ব অংশে ছােট একটি একতলা দালান। এ দালানে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষিত আছে। বাগানের মাঝে একটি বড় পুকুর। তার চারপাশে তাঁবু খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে গােপন ট্রেনিং ক্যাম্প। মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ৪০০ তরুণ যােদ্ধাকে বাছাই করা হয়েছে নৌ কমান্ডাে ট্রেনিং দেয়ার জন্য। ঐতিহাসিক আম্রকানন আর মনুমেন্টের পশ্চিম প্রান্তে বিশাল পলাশীর মাঠ। সে মাঠের পশ্চিম সীমানা ছুঁয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা ভাগিরথী নদী। দু’পাশে ঘন বাবলা বন। গােপনীয়তার কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জাদরেল ক’জন অফিসারসহ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল (অবঃ) আতাউল গণি ওসমানী এ স্থানটিকে নির্বাচন করেন। এ অঞ্চলটি ছিল নির্জন এবং বিশেষ ধরনের সাঁতার প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত স্থান। মে একাত্তর। বাংলাদেশ থেকে আগত যােদ্ধারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে। মে মাসের ২৩ তারিখে নৌ কমান্ডােদের ট্রেনিং শুরু হয়েছে।
ভাের পাঁচটা থেকে ট্রেনিং শুরু। বাঁশি বাজার সাথে সাথে ফল ইন’ অর্থাৎ মাঠে গিয়ে লাইনে দাঁড়াল। ৪০০ জনকে পূর্বেই তিনগ্রুপে ভাগ করা হয়েছে ‘এ’ ‘বি’, ‘সি’ গ্রুপ নাম দিয়ে। এবার সেই গ্রুপকে এ-১, বি-২, বি-১, সি-১, সি-২ মােট ছয় দলে ভাগ করা হয়েছে। এ দলগুলাের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন জি এম মার্টিস ও এস কে দাশ। দু’জনই ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসার। প্রতিদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত পিটি প্যারেড। তারপর শুরু হয় সুইমিং প্র্যাকটিস। ৯টা থেকে সকাল ১১.৩০ মিনিট পর্যন্ত স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার বিরতিহীন ভাবে। এর পূর্বে সবাইকে ১০টি করে ডাইভ দিতে হয়। কার কি ভুল হচ্ছে তা মার্টিস সাহেব শুধরিয়ে দিচ্ছেন। বিরামহীন সাঁতার চলে নিঃশব্দে। সবাই সাঁতার কাটছে সুইমিং স্লিপ, ফিনসকুকে গামছা দিয়ে বাঁধা পাঁচ ছয় কেজি ওজনের ইটের টুকরাে সাথে নিয়ে। অর্থাৎ লিমপেট মাইন বহন করার প্র্যাকটিস। অপারেশনের সময় এ ভাবেই বুকে লিমপেট মাইন বেঁধে নিতে হবে। সাড়ে এগারােটায় আবার বাঁশি বাজলে সবাই তীরে ওঠে আসে ক্লান্তশরীরে। মাত্র ৩০ মিনিট বিশ্রাম। তারপর আবার দমের প্র্যাকটিস শেষ হওয়ার পর সবাই পানি থেকে উঠে আসে। তখন সবাইকে দেয়া হয় এক গ্লাস লাইম জুস। শরীরের গ্লুকোজের পরিমান বাড়াবার জন্যে। আবার শুরু হয় ভােলা মাঠে আন আর্মড কমব্যাট ক্লাস। বিনা অস্ত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশল। এক নাগাড়ে ১.৩০ মিনিট পর্যন্ত। তারপর দুপুরের খাওয়া। বিশ্রাম বিকেল পর্যন্ত। বিকেলে বিভিন্ন ধরনের খেলাধূলা। সন্ধ্যায় হালকা নাস্তা। সন্ধ্যার পর আবার পানিতে ট্রেনিং।
রাত ১২ টায় পানি থেকে উঠে খাওয়া ও ঘুম। এভাবেই চলছে ট্রেনিং। অবশ্য এক সপ্তাহ ট্রেনিং শেষে ৩৫ জনকে শারীরিক দিক থেকে অসমর্থ বিবেচিত হওয়ায় বিহারের চাকুরিয়া ক্যাম্পে গেরিলা ট্রেনিং এর জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। যাদের বিহারে পাঠানাে হয়েছিল তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, নেভাল কমান্ডাে অপারেশনের প্রথম ধারা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা যেন বাংলাদেশে অপারেশনে অংশগ্রহণ না করে। গােপনীয়তার জন্যই এ নির্দেশ ছিল। এভাবে কিছুদিন ট্রেনিং চলার পর শুরু হল ডেমােলিশন ক্লাস। এ দায়িত্ব পালন করেছেন ক্যাপ্টেন এস কে দাশ এবং সহযােগী হিসেবে জুনিয়র অফিসার কে সিং, এল সিং এবং সি সিং। প্রথমেই লিমপেট মাইন, প্লাষ্টিক এক্সপ্লোসিভসহ বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ চলল। এছাড়াও ট্রেনিং এর সময় নদীতে কমান্ডােদের চারপাশে স্পীড বােট দিয়ে উঁচু ঢেউ সৃষ্টি করা হত। যেন অপারেশনের সময় ঢেউ তাদের অসুবিধে সৃষ্টি করতে না পারে। কুচরীপানা দিয়ে কেমােফ্লেজ তৈরি করে কি ভাবে নাক ভাসিয়ে পালানাে যায় তাও প্র্যাকটিস করান হয়। প্রতি রােববার ছিল রিক্রিয়েশন ডে।
নৌকমান্ডাে দল গঠন প্রসঙ্গে এখানে ক’জন বীরের কথা বলতেই হবে। মার্চের প্রথম থেকেই পাকিস্তানী সাবমেরীন পিএন এস ম্যাংরাে ফ্রান্সের তুলন সাবমেরীন ডকইয়ার্ডে এসেছে সাবমেরীনারদের ট্রেনিং এর জন্য। সেখানে ১৩ জন বাঙালি আর সবাই পাঞ্জাবী। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘােষণা করলে ১৩জন বাঙালি দুঃখ পেলেন। এভাবে চলছিল তাঁদের জীবন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তারা সবই বুঝে ফেলেন। ২৬শে মার্চ সাবমেরীনের একটি কক্ষে বসে তারা বিবিসির সংবাদ শুনলেন। ১৩ই জন ক্রু ঢাকায় পাকবাহিনীর গণহত্যার খবর শুনে ছাইচাপা আগুনের মতাে জ্বলতে থাকেন। সিদ্ধান্ত নেন সাবমেরীন হাইজ্যাক করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেবেন। পাকিস্তানে ৪জনের পরিবার পরিজন রয়েছে। তাদের কথা চিন্তা করে অন্য সিদ্ধান্ত নিতে হল। ২৭শে মার্চ নয়জন বসলেন পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। সিদ্ধান্ত হল তারা পালাবেন। যােগ দেবেন মুক্তিযুদ্ধে। ৩০শে মার্চ মার্কেটিং-এর নাম করে বেরিয়ে পড়লেন নয় জন নৌ ব্যারাক থেকে। ভঁরা হলেন রহমত উল্লাহ, মােশাররফ হােসেন, শেখ আমান উল্লাহ, এ ডব্লিউ চৌধুরী, আহসান উল্লাহ, আব্দুল রকিব, আব্দুল মান্নান, আবেদুর রহমান। এবং বদিউল আলম। কিন্তু একজন আব্দুল মান্নান পথে ভুলে অন্য পথে চলে গেছেন। অবশেষে আট জনই পাড়ি জমালেন অজানার পথ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে ৯ই এপ্রিল ৮ জন বীরবাঙালি এসে পৌঁছেন দিল্লীতে। সেদিন সকাল ৯.৩০ মিনিটে ইন্ডিয়ান কমান্ডার মিঃ শর্মা তাঁদের আট জনকে সম্মানের সাথে রিসিভ করলেন। তারপর ঐ আটজনের সাথে আরাে ক’জনের মিলন ঘটিয়ে ২০ জনের একটি গেরিলা দল গঠন করে তাদের এপ্রিলের ২৫ তারিখ থেকে মে মাসের পনরাে তারিখ পর্যন্ত দিল্লীর কুতুবমিনারের পাশে পাহাড়ী এলাকায় গেরিলা ট্রেনিং দেয়া হয়। তারপর তারা এলেন কোলকাতায়। একদিন বীর ৮ জনকে দেখতে এলেন মেজর এমএ জলিল। তাঁর সাথে ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডার ভট্টাচার্য। মিঃ ভট্টাচার্য এক সময়ে বরিশালের লােক ছিলেন। মেজর জলিলের পরামর্শ অনুযায়ী একদিন এলেন জেনারেল ওসমানী। তিনি এসে দেখেন বীরদের। ভাবলেন নৌকমান্ডাে দল গঠনের কথা। তারপর নৌকমান্ডােদের ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করার জন্য কাজ শুরু করেন। অবশেষে ২৩ই মে শুরু হল ট্রেনিং। পলাশীর আম্রকাননের পাশেই ভাগিরথীকে বেছে নিলেন ১৭৫৭ সালের কথা চিন্তা করে। গঠন করলেন গােপন নৌকমান্ডােদের ট্রেনিং ক্যাম্প। যার সাংকেতিক নাম সিটু-পি।। দু’মাসের পূর্ণ ট্রেনিং শেষ করে নৌকমান্ডােরা এবার দেশে ঢুকবে পাকবর্বরদের হৃদপিন্ডে আঘাত হানতে। নৌকমান্ডােদের ৬০ জনকে চট্টগ্রাম, ৬০ জনকে খুলনার মঙ্গুলা, ২০ জনকে নারায়নগঞ্জ, ২০ জনকে চাঁদপুর পাঠানাের ব্যবস্থা হল।
চট্টগ্রামের দলকে প্রথমে ব্যারাকপুর হয়ে আগরতলায় হরিনা ক্যাম্পে ১ নং সেকটারের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলামের নিকট প্রেরণ করে। তিনি এবং ভারতীয় অফিসার ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং দু’জনে অপারেশন পরিকল্পনা করেন। অপারেশন জ্যাকপটের জন্য এডব্লিউ চৌধুরী। কমান্ডার এবং ডাঃ মাহ আলমকে ডেপুটি কমান্ডার করা হয়। এর দলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এক নম্বর গ্রুপের গ্রুপ লিডার মাজহার উল্লাহ, দু’নম্বর গ্রুপের ডাঃ। শাহ আলম, তিন নম্বর গ্রুপের আব্দুর রশীদ। এ গ্রুপগুলাের সহ গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে এলেন ফারুক-ই-আজম বিধান ও আরাে একজনের নাম হয় অপারেশন জ্যাকপট। পুরাে অপারেশন নিয়ন্ত্রিত হবে রেডিওর গানের মাধ্যমে। আকাশবাণী থেকে সেই গান দুটো বাজানাে হবে। গান শুনে কমান্ডাররা প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। খুলনার কমান্ডার আহসান উল্লাহ, চাদপুরের কমান্ডার আমিন উল্লাহ শেখ, নারায়নগঞ্জের কমান্ডার আবেদুর রহমান, চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার এডব্লিউ চৌধুরী এবং সহ কমান্ডার ডাঃ শাহ আলমকে মেজর রফিকুল ইসলাম পুরাে ব্যাপার জানিয়ে দিলেন। সাথে দিলেন দুটো এক ব্যান্ডের রেডিও। কমান্ডার এডব্লিউ চৌধুরী ৬০ জনকে আবার দেশে প্রবেশ করার সুবিধার্থে ৪ গ্রুপে ভাগ করে দেন। মাজহার উল্লাহর নেতৃত্বে এক গ্রুপ, শাহ আলমের নেতৃত্বে এক গ্রুপ, আব্দুর রশিদের নেতৃত্বে এক গ্রুপ এবং এ ডব্লিউ চৌধুরীর নেতৃত্বে এক গ্রুপ করেন। তারপর প্রয়ােজনীয় অস্ত্র দিলেন। লিমপেট মাইন ও অন্যান্য অপারেশন সামগ্রী নিয়ে তারা সাধারণ পােষাকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। পুরাে রাত হাঁটেন আর দিনে গাইডারদের আশ্রয় কেন্দ্রে ঘুমিয়ে কাটান।
পরে ফেনী নদী জোরালগঞ্জ হয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসেন। নৌকমান্ডাে যাদের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তাঁরা হলেন সর্ব জনাব, এডব্লিউ চৌধুরী, শাহ আলম, ফারুখ-ই-আজম, আবু মুছা চৌধুরী, মাজহার উল্লাহ, আব্দুর রশিদ, জয়নুল আবেদীন, কাজল, আবু বক্কর ছিদ্দিক, আবু তাহের, মনু, এমদাদ, নুরুল হক, শফিকুন নুর, মাওলা, হাশেম, মােঃ হােসেন, আমীর হােসেন, মনােজ কুমার, বদিউল আলম. সেলিম বাঙালি, অরুণ, চুনু, অনিল বরুণ রায়, বাশার, বশীরসহ মােট ষাট জন। পথে বিভিন্ন গ্রুপকে পথ দেখিয়ে আনেন আনােয়ার, জানে আলম, বদিউলসহ আরাে ক’জন। | ১৩ই অগাস্ট ভাের ৬টায় রেডিওর মাধ্যমে অপারেশন সিগন্যাল এসে গেছে। প্রথম সিগন্যাল গান আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি’ আকাশবাণী থেকে বাজানাে হয়েছে। কমান্ডার চৌধুরীর হাতে মাত্র ৪৮ ঘন্টা সময়। এ সিগন্যাল ৬০ জনের মধ্যে মিঃ চৌধুরী ও শাহ আলম ছাড়া কেউ জানে না। অন্যরা কেউ জানতে পারল না মূল আঘাত হানতে হবে ৪৮ ঘন্টা পর। শাহ আলমকে সীতাকুন্ড থেকে সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে পাঠিয়ে দিলেন চট্টগ্রাম শেল্টারে যােগাযােগ করতে। ৩ নম্বর গ্রুপ রশিদের নেতৃত্বে সমুদ্রতীর দিয়ে চরলক্ষার মূল আস্তানায় পৌছবে। খুরশীদের দায়িত্ব লিমপেট মাইন, অস্ত্র ও অপারেশন সরঞ্জাম হাতে পৌছে দেয়া। দুপুর ১২ টায় খুরশীদ, জানে আলম একটি এ্যাম্বুলেন্স এবং একটি ওয়াপদার পিকআপ ভ্যানে তােলে অস্ত্র।
ওয়াপদার পিকআপ ভ্যানটি যােগাড় করে দিয়েছেন ওয়াপদার এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার আলতাফ হােসেন এবং সিফট-ইন চার্জ আবু তাহের। সুন্দর করে তরিতরকারি বােঝাই করে পিকআপ ভ্যানে। ভ্যান চলতে শুরু করল। এ্যম্বুলেন্সে উঠলেন কমান্ডার এ ডব্লিউ চৌধুরী আর খুরশীদ। অস্ত্র ভর্তি পিকআপ ভ্যান চলে এসেছে মৌলভী পাড়ায়। হালীশহর রােডে গাড়ি থামল। কৌশলে অস্ত্রগুলাে রাখা হল পানওয়ালা পাড়া, মৌলভী পাড়া, হাজী পাড়া আব্দুল মােনাফ সওদাগরের বাড়ি, হােন্ডা প্যালেসের নূরুল ইসলাম নানা, তালেব আলীর বাড়ি, আগ্রাবাদ কলােনীর পেছনে মমতাজ মহলে। শাহ আলম, মজহার উল্লাহ পূর্বেই চলে এসেছে সবুজ বাগে। দু’গ্রুপের ৪০জন সবুজবাগ ও হাজীপাড়া জালালউদ্দীন আহমেদের বাড়িতে উঠেছে। পরে বিভিন্ন শেল্টারে তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। নৌকমান্ডােদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, আবু সাঈদ সরদার, জালালউদ্দিন আহমেদ, নূর মােহাম্মদ মিন্টু, মঈনুদ্দিন খান বাদল, লােকমান গণি, মােঃ হারেস, নুরুল ইসলাম, কায়সার, ইউনুস, আতাউর, আবু সিদ্দিক সরদার, আব্দুল বারেক, আমীর হােসেন, আব্দুন নূরসহ ক’জন। কমান্ডার চৌধুরী উঠেছেন মেহেদীবাগে মুক্তিযােদ্ধা মাওলার বাসায়। সেখানে মিসেস মাওলার রান্না খেয়ে চলে আসেন নাসিরাবাদের ইষ্টার্ণ রিফাইনারীর জেনারেল ম্যানেজার আজিজুর রহমান এবং ইঞ্জিনিয়ার মতিনের অপেক্ষা স্থলে। সাথে রয়েছে খুরশীদ। মিঃ চৌধুরীর পরনে কাবুলী ড্রেস। আলাপ হল। রেকির দায়িত্ব নিলেন ইঞ্জিনিয়ার মতিন। গাড়িতে উঠলেন সবাই। হালীশহর রােডের পানওয়ালাপাড়ার মুখে মিঃ চৌধুরীকে নামিয়ে দিয়ে মতিন ও আজিজ সাহেব চলে গেলেন পতেঙ্গায় রেকি করতে।
| রাত তখন ৮টা। একজন লােক কাবুলী ড্রেস পরে পথ চলছে। তাকে দেখেই বিশ বছরের এক যুবক কাছে এল। পথ চলতে আস্তে আস্তে করে কাবুলী ড্রেস পরা লােকটির কাছে এসে বললে, আজ বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। এ কথা শুনে কাবুলী ড্রেসপরা লােকটি বলল, আকাশ তাে মেঘালই দেখছি।’ এ দুটি বাক্য ছিল সাংকেতিক। কাবুলী লােকটি মিঃ চৌধুরী, অন্যজন মুক্তিযােদ্ধা আবু সাঈদ সরদার। শেল্টারে এসে দেখেন শাহ আলম ও মজহার উল্লাহ এসে গেছেন। কতক্ষণ পর মিঃ চৌধুরী বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় শাহ আলমকে গােপনে ডেকে বললেন, সন্ধ্যায় চেকব্যাক সিগন্যাল পাওয়া গেলে আগামীকাল সকালে এ্যাকশন সিগন্যালের জন্য রেডিও শুনবে।’ চলে এলেন তিনি মেহেদীবাগ।  ১৪ই অগাস্ট সকাল ৬টা। শাহ আলম রেডিওর নব ঘুরিয়ে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে সেট করল। কিছুক্ষণ পরই বেজে উঠল ‘আমি তােমায় যতাে শুনিয়েছিলাম গান তার বদলে চাইনি প্রতিদান। পুরাে দেহ মন চঞ্চল হল শাহ আলমের। একই সাথে মেহেদীবাগ থেকে রেডিও শুনেছেন মিঃ চৌধুরী। আর মাত্র ২৪ ঘন্টা। তারপরই মূল অপারেশন শুরু হবে অর্থাৎ ১৫ই অগাষ্টের রাত ১১টা থেকে ৩টার মধ্যে অপারেশন সম্পন্ন করতে হবে। ৪০ জন নৌকমান্ডােকে পুরাে ঘটনা জানান হল। মুক্তিযােদ্ধারা সদর ঘাট হয়ে বিভিন্ন কৌশলে নদী পার হন। মুক্তিযােদ্ধা জালাল উদ্দিন আহমেদ, আবু সাঈদ সরদার, নুরুল ইসলাম, নূর মােহাম্মদ মিন্টুসহ ঠেলাগাড়িতে করে তরিতরকারী ও ভূষির ভিতরে করে জ্যাকপটের সকল অস্ত্র নদীর ওপাড়ে পাঠান। গাইডার হিসেবে ছিলেন আবু সিদ্দিক সরদার। নৌকমান্ডােরা পৌছেন চরলক্ষায় কালা মিঃ সওদাগরের বাড়িতে। নৌকমান্ডােরা জেলেদের পােষাকে কালা মিয়া সওদাগরের বাড়ি, ইউনুস, সগীর এবং স্থানীয় মেম্বারের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার মতিন সাহেবের রেকির ফলাফল এসে গেছে। ১৫ তারিখ দিনে দু’জন নৌকমান্ডােকে দিয়ে পুরনায় রেকি করান হল। দুটি রেকির ফলাফল মিলে গেল, রেকি ইনফরমেশন, পাের্ট সিকিউরিটি ইনফরমেশন এবং টাইড চার্ট নিয়ে পূর্বেই এসেছেন কমান্ডার চৌধুরী। তখন আব্দুর রশিদের দলের ২০ জন এসে পৌছেনি। চিন্তায় সবাই।
এল মহেন্দ্রক্ষণ। নৌকমান্ডােদের তিনগ্রপে ভাগ করা হল। অবশেষে আব্দুর রশীদের গ্রুপকে অপারেশন থেকে বাদ দিয়েই পরিকল্পনা করা হয়। রাত তখন ১টা। নৌকমান্ডােরা মৃত্যুর পথে চলেছে। মুখে কাদা মেখে পানিতে নেমেছে ১১টি গ্রুপ। প্রতি গ্রুপে ৩ জন করে। টার্গেট ১১টি জাহাজ। সবার পরনে স্যুইমিং স্লিপ, পায়ে ফিন্স, বুকের মাঝে লিমপেট মাইন গামছা দিয়ে বাঁধা। পায়ের খাপে ছুরি। শাহ আলমের হাতে ওয়াটার রেডিয়াম ঘড়ি। চিৎসাঁতারে এগুচ্ছেন সামনে। হাতে ছােট ডাল ও একটি করে কচুরী পানার আড়ালে নাক ভাসিয়ে চলছে সবাই। ১১টি গ্রুপ ১১টি জাহাজে ডুব দিয়ে জাহাজের খােল থেকে ছুরি দিয়ে শ্যাওলা পরিস্কার করে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দিল। লিমপেট মাইনে হাইম্যাগনেটিভ ডিভাইডার লাগান আছে। চুম্বক শক্তির কারণে জাহাজে লেগে গেল। তারপর সবাই ভাসতে ভাসতে ফিরে আসে নির্দিষ্ট স্থানে। অল্প কতক্ষণ পর পর প্রচন্ড বিস্ফোরণ। চট্টগ্রাম বন্দর কেঁপে উঠল। ১২ নম্বর জেটিতে নােঙ্গর করা এমভি আব্বাস ১০৪১ টন সামরিক সরঞ্জাম, ১৩ নম্বর জেটিতে এমডি হরমুজ ৯৯১০ টন সামরিক সরঞ্জাম, মৎস্য বন্দর জেটিতে ওরিয়েন্ট বার্জ ৬২৭৬ টন অস্ত্র, নেভাল জেটিতে একটি বার্জ, দুটো গানবােটসহ বেশ ক’টি জাহাজ চোখের পলকে ডুবে গেল। তারপর নৌকমান্ডােরা চলে এলেন পটিয়ায়। চট্টগ্রাম বন্দরে নৌকমান্ডােদের বীরত্বপূর্ণ অপারেশন পাকবাহিনীর দম্ভ ধূলােয় মিশিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিবেক দেখেছে আশ্চর্য হয়ে। পাকসামরিক সরকারের মাথা নিচু হয়েছে। স্বাধীনবাংলা বিপ্লবী বেতার থেকে এ অপারেশনকে দুঃসাহসী বলে চমক্কার করে বর্ণনা দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম এ অপারেশনকে ফলাও করে প্রচার করেছে। অপারেশন জ্যাকপটের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি ভারতীয় নৌবাহিনীর এসকে দাশ। তিনি নৌকমান্ডােদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে ফেরার পথে জীপ দুর্ঘটনায় মারা যান।

(সূত্র রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!