You dont have javascript enabled! Please enable it!

মংলা পোর্টের বাহাদুর শ্রমিক ভাইয়েরা

খুলনা জেলার মঙ্গলা পোর্ট। চালনার মতো এই বন্দরেএ দেশ বিদেশের জাহাজ যাতায়াত করে। রফতানির মাল জাহাজে ওঠে আর আমদানির মাল জাহাজ থেকে নামে। কিন্তু অন্যান্য বন্দরের মতো এখানে জাহার ভিড়াবার মতো কোনো ডক ইয়ার্ডের ব্যবস্থা নাই। জাহাজগুলিকে মুরিং বয়ার সঙ্গে বেঁধে দিয়ে মালপত্রের ওঠানামা চলে।

মঙ্গলা পোর্ট খুলনা শহর থেকে বহু দূরে। জলপথ ছাড়া সেখানকার সঙ্গে যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে মঙ্গলা পোর্ট যেন সবকিছু থেকে একপ্রান্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। সারা প্রদেশজুড়ে স্বাধীন বাংলার আন্দোলন চলছে। কিন্তু এখানে তেমন কোনো আন্দোলন নেই। তারপরেও এই বাংলাদেশের যেখানেই যতদূরেই থাকুক না কেনো, আন্দোলন প্রতিটি বাঙালির মনে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। মঙ্গলার অধিবাসীরাও এই বিষয়ে একেবারে উদাসীন হয়ে থাকতে পারে না। আমি এখানে বিশেষ করে নীচের তলার সাধারণ মানুষের কথাই বলছি। মঙ্গলা বন্দরের শ্রমিক ভাইয়েরা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা না করে পারলো না। এই নিয়ে তারা পরস্পরের মধ্যে নানারকম জল্পনা কল্পনা করে কিন্তু এ সম্পর্কে তাদের কী করণীয় থাকতে পারে তা তারা ভেবে পায় না।

ক’দিন হয় একটা ফ্ল্যাট এখানে এসে পাড়ে ভিড়েছে। সবাই লক্ষ্য করেছে, এই ফ্ল্যাটের মধ্যে দশ বারো জন পাঞ্জাবী সৈন্য আছে। এক এক করে ক’টা দিন কেটে গেলো, কিন্তু ফ্ল্যাট যেমন ছিলো তেমনই আছে।

এমন তো কখনো হয় না! এই সৈন্যগুলি এখানে বসে বসে করছে কী! ওদের নিশ্চয়ই খারাপ মতলব আছে। ………….

শ্রমিক ভাইয়েরা অতি সতর্কভাবে ওদের হালচাল গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো। তারা দেখছে ফ্ল্যাটের সেই সমস্ত সৈন্যরা বড়ই হুশিয়ার। ওরা পালা করে সারা রাত জেগে পাহারা দেয়। ওটা কি শুধুই আত্মরক্ষার জন্যই। না এর পিছনে আরো কিছু আছে? শুল্ক অফিসে অনুসন্ধান নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পাওয়া গেলো। এই ফ্ল্যাটে নাকি অনেক গোলাগুলি মজুদ করা আছে। এই সৈন্যরা তারই জিম্মাদার।

খবরটা পেয়ে শ্রমিকরা অধির হয়ে উঠলো। এমন চমৎকার মওকা খুব কমই পাওয়া যাবে। এই সময়ে আক্রমণ করতে পারলে অতি সহজেই ওদের সব কয়টাকেই খতম করে দেওয়া যাবে আর তারই সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে গোলাগুলি উদ্ধার করা যাবে। এইভাবে এক বাণে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কেমন করে এই কাজ হাসিল করা যাবে?

অনেক চিন্তা ভাবনার পর অবশেষে একটা পথ পাওয়া গেলো।

এখানে বসে কিছু করা যাবে না। মুক্তিবাহিনীকে খবর দিতে হবে। তারা অবশ্যই এর উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারবেই। কিন্তু কোথায় আছে মুক্তিবাহিনী, তারা কেমন করে মুক্তিবাহিনীর সন্ধান পাবে? একজন বললো, সে শুনেছে বাগেরহাট শহর এখনো মুক্তিবাহিনীর দখলে আছে। খবরটা সত্য কিনা তা জোর করে বলা যায় না। তাহলে একবার সেখানে গিয়ে চেষ্টা করে দেখা দরকার। তার এই প্রস্তাবটা সবাই একবাক্যে সমর্থন করলো।

বাগেরহাট শহর এখান থেকে বত্রিশ মাইল দূরে। বর্তমানে নৌকা ছাড়া সেখানে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি যেতে হয় এক্ষুণি যেতে হবে। একটু দেড়ি করলেও চলবে না। অবস্থা অত্যন্ত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। পরে এমন সুযোগ নাও মিলতে পারে। যেমন প্রস্তাব তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন শ্রমিক নৌকা পথে বাগেরহাট রওয়ানা হয়ে গেলো।

খবরটা মিথ্যা নয়। মুক্তিবাহিনী এখনো বাগেরহাট শহর অধিকার করে বসে আছে। বরিশালের প্রাক্তন সামরিক অফিসার মেজর জলিল এই মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এবং তিনিই ছিলেন তাদের পরিচালক।

তারা যে উদ্দেশ্যে সেখানে এসেছিলো তা সিদ্ধ হলো। মেজর জলিল তার প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন।

তার দু’দিন বাদে মঙ্গলবার ঘুমন্ত অধিবাসীরা গভীর রাত্রিতে চমকে উঠে শয্যা ছেড়ে উঠে বসলো। মেশিনগান আর রাইফেলের শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে চলেছে। ভয়ে কেঁপে উঠলো তাদের মন। তবে কি বর্বর পাক সৈন্যরা বাঙালির উপর হামলা করেছে? উদ্বেগ উৎকন্ঠায় সবাই ঘর ছেড়ে ছুটে এলো বাইরে। পরে খবর শুনে অসশ্বস্ত হলো। না, পাক সৈন্যরা নয়, তাদের অতি প্রিয় মুক্তিবাহিনী সেই ফ্ল্যাটের সৈন্যদের উপর আক্রমণ করেছে।

সব ক’টা সৈন্যকে ওরা নিঃশেষ করে দিয়েছে। আরও জানা গেলো, ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে অনেক অস্ত্র ও গোলা-গুলি উদ্ধার করা গেছে।

——————————————————

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!