You dont have javascript enabled! Please enable it!

সেনাবাহিনী আসার খবরে নিশ্চিত বােধ করেছিলেন শেখ কামাল

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে সামরিক ও গােয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে মামলার দলিলের ভিত্তিতে

ধারাবাহিক প্রতিবেদন-১

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি প্রথম দফা আক্রান্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনীর যে সদস্যদের দেখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল স্বস্তি আর নিশ্চিত বােধ করেছিলেন, তারাই প্রথমে তাঁকে এবং এরপর একে একে অন্যদের হত্যা করেছে। মামলার বাদী এবং এক নম্বর সাক্ষী মুহিতুল ইসলামের সাক্ষ্যে অবশ্য এটাও স্পষ্ট হয়েছে, প্রথম হামলার পরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর নিরাপত্তায় ৩২ নম্বরে অবস্থান করা নিরাপত্তাকর্মীরা কেউ কিছু করছে না। আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এতাে গুলি হচ্ছে, তােমরা কি করাে!’ বলে বিরক্তিও প্রকাশ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। মুহিতুল ইসলাম বলেন, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু যখন গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে দোতলা থেকে নীচে নেমে সেনা সদর, পুলিশ কন্ট্রোল রুম, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং গণভবনে টেলিফোন করার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক তখনই এক ঝাঁক গুলি দক্ষিণ দিকের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে নীচতলার অফিসকক্ষের দেয়ালে লাগে। বঙ্গবন্ধু তখন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহিউদ্দিনকে টেলিফোনে পেয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময়ই গুলিতে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে তাঁর ডানহাতের কনুইয়ে লেগে রক্ত ঝরতে থাকে। সেসময় বঙ্গবন্ধু এতাে গুলি কিসের?” জানতে চাইলে একজন সেন্ট্রি বাইরে থেকে হামলার কথা জানান বলে জানিয়েছেন মামলার ৫০ নম্বর সাক্ষী সাবেক পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম খান।

ডিএসবির প্রটেকশন ফোর্সের সদস্য হিসেবে তখনকার হাউস গার্ডের দায়িত্বে থাকা নুরুল ইসলাম খান সেন্ট্রিদের ‘কাউন্টার ফায়ারিংয়ে প্রতিরােধ গড়ে তােলার কথা বললেও নিরাপত্তাকর্মীদের কেউ সেটা করে নি। সেসময় কালাে এবং খাকি পােষাকধারী কিছু সেনাসদস্য ‘পূর্ব-দক্ষিণ এবং পশ্চিম-দক্ষিণ দিক থেকে ক্রলিং করে বাড়ির দিকে আসছে দেখে বঙ্গবন্ধু দোতলায় চলে যান। এর পরপরই বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল নীচে নেমে এসে নুরুল ইসলামকে জিগগেশ করেন, আর্মি কি এসেছে? উত্তরে তিনি বলেন, মনে হ্যাঁ এসেছে। ধারণা করা হয়, এর আগেই বঙ্গবন্ধু তাঁর শয়নকক্ষ থেকে টেলিফোনে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এবং বিদায়ী প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পেরেছিলেন। তাই প্রেসিডেন্টের জীবন রক্ষায় সেনা সদস্যদের আশা করছিলেন শেখ কামাল। তখন শেখ কামাল উৎফুল্ল হয়ে বলেন, আর্মি ভাইয়েরা কারা এসেছেন ভেতরে আসেন। দ্বিতীয়বারও একই কথা উচ্চারণ করেন, জানিয়ে নুরুল ইসলাম খান বলেন: কিছুক্ষণ কোনাে সাড়াশব্দ ছিলাে না। পরে হঠাৎ ৫/৬ জন কালাে ও খাকি পােষাকধারী আর্মি গেট ধাক্কা দিয়ে বাড়ির দিকে এগােতে থাকে।

কিছুদূর এগিয়ে তারা ‘হ্যান্ডস-আপ’-এর নির্দেশ দিলে তিনি এবং এক পুলিশ সার্জেন্ট ‘হ্যান্ডস-আপ’ করেন। শেখ কামাল কিছুটা আশ্চর্য হয়ে হাত উঠিয়ে বলেন, আমি শেখের ছেলে কামাল। তারা দ্বিতীয়বার ‘হ্যান্ডস-আপ’ বললে হ্যান্ডস-আপ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করে,’ জানিয়ে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তাকেও দুটি গুলি করা হয়। প্রসিকিউশনের ছয় নম্বর সাক্ষী হাবিলদার সােহরাব আলী জানিয়েছেন, শেখ কামাল সেখানে এসে ‘আর্মিপুলিশ ভাই আপনারা আমার কাছে আসেন’ বলার পর খাকি পােষাকধারী ক্যাপ্টেন হুদাসহ অন্য অফিসাররা শেখ কামালকে গুলি করে। শেখ কামাল চীৎকার করে রিসেপশন রুমের কাছে পড়ে যান। ক্যাপ্টেন হুদা তখন আবারও তাকে গুলি করে। যে সেনা সদস্যদের শেখ কামাল তাদের জন্য উদ্ধারকারী মনে করেছিলেন, তারা কিভাবে তাকে হত্যা করেছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন মামলার বাদী এবং প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের রেসিডেন্ট পি,এ মুহিতুল ইসলাম।

তিনি বলেছেন: শেখ কামাল আর্মি ভাই, পুলিশ ভাই আপনারা আমার সঙ্গে আসেন বলার পর ৩৪ জন কালাে ও খাকি পােষাকধারী সশস্ত্র আর্মি এগিয়ে আসে। খাকি পােষাকধারী মেজর হুদা শেখ কামালের। পায়ে গুলি করে। শেখ কামাল তখন শেখ মুজিবের ছেলে কামাল হিসেবে নিজের পরিচয় দিলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে হুদা। আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে গুলি ছিলাে না। 

প্রতিবেদন-২

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় নিয়ােজিত সেনা সদস্যদের কাছে নিয়মিত আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও তাদের কাছে কোনাে গুলি ছিলাে না। প্রথম দফা আক্রমণের আগেই তাদের কাছ থেকে ইউনিটের সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাব জোয়ার্দার সব গুলি নিয়ে যায়। এই সুবেদার মেজরকে হত্যাকাণ্ডের পরপরই র‍্যাংক ব্যাজ পরিয়ে লেফটেন্যান্ট হিসেবে ঘােষণা করে সৈয়দ ফারুক রহমান।

সেসময়ের ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারির যে ইউনিটটি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলাে, তার একাধিক সদস্যের সাক্ষ্যে আব্দুল ওয়াহাব জোয়ার্দারের গুলি নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এসেছে। তাদের একজন প্রসিকিউশনের পাঁচ নম্বর সাক্ষী সুবেদার গণি।

তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ক্যাপ্টেন বাশারের (তিনিও একজন সাক্ষী) নেতৃত্বে তাদের রেজিমেন্টের ১০৫/১০৬ জনের এক কোম্পানি ফোর্সকে ঢাকায় বদলি করা হয়। তিনিসহ অন্যরা আগস্ট মাসের ১২ তারিখ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ডিউটি শুরু করেন। পালাক্রমে ডিউটি শেষে তারা ৩১ নম্বর বাড়িটিতে থাকতেন।

রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সুবেদার গণি একজন গার্ড কমান্ডার ছিলেন। তিনি জানান: ১৫ আগস্ট ভাের আনুমানিক সােয়া ৪টার দিকে তাদের রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাব জোয়ার্দার এসে গার্ড পরীক্ষা করেন। তারপর তিনি (জোয়ার্দার) বলেন, “তােমাদের পুরাতন গুলি দিয়ে দাও, আমি নতুন গুলি দিচ্ছি।’ গুলি নিয়ে জোয়ার্দার জিপে উঠে চলে যায়, কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীদের নতুন কোনাে গুলি দেওয়া হয়। নি।

কিছুক্ষণ পর অপর গার্ড কমান্ডার হাবিলদার কুদুস (তিনিও একজন সাক্ষী) গার্ডদল নিয়ে ডিউটির জন্য। আসলে গণি তাকে গুলি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তবে তখনও তারা বুঝতে পারেন নি যে কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে! তাই যথারীতি নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করেন। বিউগলের সুরে পতাকা উত্তোলনের শেষ মুহূর্তে ধানমণ্ডি লেকের দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড গুলি শুরু হয়।

গণি জানান, ৫/৭ মিনিট পর গুলি বন্ধ হলে রুম থেকে বের হয়ে দেখেন ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর নুর আরাে ৭/৮ জন খাকি ও কালাে পােষাকধারীসহ সশস্ত্র অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে গাড়ি থেকে নামছে। তারাসহ ল্যান্সারের মেজর মুহিউদ্দিনসহ ‘হ্যান্ডস-আপ’ ‘হ্যান্ডস-আপ’ বলতে বলতে আর গুলি করতে করতে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়।

প্রেসিডেন্ট গার্ডদের তখন কি অবস্থা সেটা বর্ণনা করেছেন চার নম্বর সাক্ষী হাবিলদার কুদুস। তিনি জানান, দক্ষিণে লেকের দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে লাগাতার গুলি আসতে থাকলে তিনি গার্ডদলসহ দেওয়ালে লাইন পজিশনে যান। গুলি বন্ধ হওয়ার পর পাল্টা গুলি করার জন্য গুলি খোঁজাখুঁজি শুরু করলে বুঝতে পারেন, সকল গার্ডের কাছ থেকেই গুলি নিয়ে গেছে তাদের সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাব জোয়ার্দার।

সেনাবাহিনীতে সুবেদার মেজর পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার মাধ্যমেই সৈন্যদের সঙ্গে কমিশন্ড অফিসাররা যােগাযােগ করেন, নির্দেশনা পৌছান। বাস্তব অর্থে সুবেদার মেজরকে অধীনস্তরা তাদের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই ওই সময় কুমিল্লাভিত্তিক ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারির সুবেদার মেজর জোয়ার্দার সেখান থেকে সৈনিকদের বেতনের টাকা এনে বিতরণের সময় গুলি নিয়ে যাওয়ায় কারাে চ্যালেঞ্জ জানানাের সুযােগ ছিলাে না, সেনাবাহিনীতে সেটা সম্ভবও নয়।

এভাবে দেশের রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে একটিও গুলি না থাকায় সেদিন সামান্য প্রতিরােধও তারা গড়ে তুলতে পারেন নি। বরং একজন নিহত হন, আহত হন কয়েকজন। সে হিসেবে রক্তাক্ত সেই ভােরে শুধু রাষ্ট্রপতির বিদায়ী প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলই নিহত হন নি, এক নিরাপত্তারক্ষীও নিহত হন। তিনি সিপাহী শামসু। এছাড়াও স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন পুলিশ অফিসারকেও হত্যা করে খুনিরা।

প্রসিকিউশনের ৩৩ নম্বর সাক্ষী হাবিলদার সেলিম জানান, ১৫ আগস্ট আনুমানিক ভাের পৌণে ৫টার দিকে হালকা অস্ত্রের গুলির আওয়াজ শুনে দ্রুত বাইরে আসেন। তখন পেট্রোল ডিউটিতে থাকা দুইজন সিপাহী দৌড়ে এসে জানান, ট্যাংকের আওয়াজ হচ্ছে, ফায়ারিং এর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আর্টিলারির কামানের গােলা তাদের ১৫/২০ গজ পূর্বদিকে বিস্ফোরিত হয়। গােলার টুকরা তাদের চারজনকে আহত করে। তাদের মধ্যে সিপাহী শামসু সেখানেই মারা যান। এছাড়া সিপাহী মােফাজ্জল গুরুতর এবং অন্য দুইজন সামান্য আহত হন।

হাবিলদার সেলিম জানিয়েছেন, তিনি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সকাল সাড়ে ৭টা/৮টার দিকে জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে গণভবনের ব্যারাকে শােয়া অবস্থায় পান।

ওই গণভবন এবং ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারির যে সদস্যরা ছিলেন, তাদের বেতন। দেওয়ার নামেই কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছিলাে সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাব জোয়ার্দার। সুবেদার গণি এবং হাবিলদার কুন্দুস ছাড়াও একাধিক সাক্ষী বলেছেন, জোয়ার্দার তাদের কাছ থেকে গুলি নিয়ে। গিয়েছিলেন যে কারণে ১৫ আগস্ট তারা সামান্য প্রতিরােধও গড়ে তুলতে পারেন নি। তবে মামলার রায়ে খালাস পায় ওয়াহাব জোয়ার্দার।

হুদা-ডালিম রেকি করে গেলেও গুরুত্ব দেয়নি কেউ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা এবং সামরিক ও গােয়েন্দা ব্যর্থতার কথা লাইনে লাইনে ফুটে উঠেছে হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে। অনেক আগে থেকে এ ব্যর্থতার শুরু এবং এর শেষ কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর খুনিদের বিদেশে পাড়ি জমানাের মধ্য দিয়ে।

গােয়েন্দা ও সামরিক ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে নাইট প্যারেড। সেখানে নৈশ। মহড়ার নামে কয়েকশ সেনাকে এক করে রাষ্ট্রপতিকে হত্যার উদ্দেশে ট্যাংকবহরসহ রওনা হওয়ার পরও সর্বোচ্চ পর্যায়ের কেউ সেটা জানতে পারেন নি, অথবা জানলেও কোনাে ব্যবস্থা নেন নি।

বড় এ ব্যর্থতার বিস্তারিত পরের পর্বগুলােতে থাকবে। এ পর্বে প্রথমে ১৪ আগস্ট বিকেলের ঘটনা।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রমাণ হয়েছে, বঙ্গবন্ধু ভবন কোনাে প্রাসাদ ৰা দূর্গ না হলেও, একাধিক খুনি ঐতিহাসিক ছােট ওই বাড়িটিতে আগে একাধিকবার গিয়ে থাকলেও; নিরাপত্তা ব্যবস্থার। সর্বশেষ অবস্থা দেখতে ১৪ আগস্ট বিকেলে কমপক্ষে দু’ খুনি বাড়িটি রেকি করে এসেছিলাে।।

তাদের একজন আগেই পদচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মেজর শরফুল হক ডালিম এবং আরেকজন সেসময় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় নিয়ােজিত ইউনিটের একজন সাবেক কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। সেখানে তাদের উপস্থিতি এবং মােটর বাইকে একাধিকবার চক্কর দেওয়াটা অস্বাভাবিক হলেও কেউ তাদের চ্যালেঞ্জ করেন নি, কোনাে গােয়েন্দা নেটওয়ার্কও বিষয়টি উর্ধর্তন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনে নি।

ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের একজন গার্ড কমান্ডার হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পাঁচ নম্বর সাক্ষী সুবেদার গণি জানিয়েছেন, কুমিল্লা ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারিতে মেজর ডালিম ও ক্যাপ্টেন হুদা তাদের অফিসার ছিলন। কিছুদিন পর মেজর ডালিমের চাকরি চলে যায়, ক্যাপ্টেন হুদা ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন।

গণি বলেছেন, ১৪ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে ডিউটিতে ছিলেন তিনি। আনুমানিক বিকেল ৪টার দিকে তিনি। তাদের আগের কমান্ডিং অফিসার ডালিমকে মােটর সাইকেলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে ঘােরাফেরা করতে দেখেন।

পরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তাদের সাবেক অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন হুদাকেও মােটর বাইকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে দিয়ে যেতে দেখেন তিনি।

সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ততোক্ষণে চূড়ান্ত হয়ে গেছে পরদিন ১৫ আগস্টই ঘটতে যাচ্ছে বর্বরতম হত্যাকাণ্ড। কিন্তু সেটা প্রতিহত করার জন্য কোনাে গােয়েন্দা তথ্য ছিলাে না। এমনকি গােয়েন্দা নেট ওয়ার্কও সক্রিয় ছিলাে না। থাকলে হুদা-ডালিম সেখানেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তাে। তার চেয়েও বড় বিষয় আইন প্রয়ােগে কঠোরতা থাকলে মেজর ডালিমের তখন বাইরে থাকার কথা না, ততােদিনে তার ঠিকানা হওয়া উচিত ছিলাে কারাগার।

তারা বলেন, মেজর ডালিম যে অপরাধ করেছিলাে তাতে শুধু পদচ্যুতিই যথেষ্ট ছিলাে না। একই কথা প্রযােজ্য আরেক খুনি মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। অপরাধের মাত্রা হিসেবে ওই । দু’জনসহ আরাে কয়েকজনের চাকুরিচ্যুতির পাশাপাশি কারাগারেই থাকার কথা ছিলাে। কিন্তু সেটা হয় নি। আর সে কারণেই তারা ইতিহাসের নৃসংশতম হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পেরেছিলাে।

তাদের অপরাধের বিষয়টা মেজর সৈয়দ ফারুক রহমানের বক্তব্যেও উঠে এসেছে। ১৬৪ ধারায় ফারুকের জবানবন্দিটা এরকম; ওইসময় লেডিস ক্লাবে মেজর ডালিমের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গােলাম মােস্তফার ছেলের সাথে অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের কিছু অফিসার ও জওয়ান গাজী গােলাম মােস্তফার বাড়ি তছনছ করে। তাতে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে মেজর ডালিম, মেজর নূর ও আরাে কয়েকজনের চাকরি চলে যায়।

সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন; এটা বিস্ময়কর যে কিছু সেনা অফিসার একজন মন্ত্রীর বাড়ি তছনছ করার পর তাদের শাস্তি হয়েছে শুধু চাকুরিচ্যুতি! কেউ কেউ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবজাত ভালােবাসার কারণে তাদের প্রতি দয়াশীল ছিলেন। এ কারণে মন্ত্রীর বাড়ি তছনছ করার পরও ডালিম এবং নূরের কারাদণ্ডের মতাে শাস্তি হয় নি। এর প্রতিদান তারা দিয়েছে সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে।

খুনিদের কেউ কেউ আবার বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের পূর্বপরিচিত ছিলাে। হুদা-ডালিম-মুরসহ খুনিদের অনেকেরই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যাতায়াত ছিলাে নিয়মিত অথবা সময় সময়।

তাদের মধ্যে শেখ কামালকে ব্রাশফায়ার করা এবং পরে ৩২ নম্বরের সামনে মেজর ফারুককে ‘অল আর ফিনিশড’ বলে রিপাের্ট করা ক্যাপ্টেন হুদা মাঝেমধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিরাপত্তার ডিউটি ফোর্সকে দেখাশােনার জন্য আসতাে বলে জানিয়েছেন মামলার এক নম্বর সাক্ষী মুহিতুল ইসলাম।

প্রসিকিউশনের চার নম্বর সাক্ষী হাবিলদার কুন্দুসের সাক্ষ্য অনুযায়ী, ক্যাপ্টেন হুদা শুধু শেখ কামালকেই হত্যা করেনি, মেজর নূরসহ স্টেনগানের গুলিতে বঙ্গবন্ধুকেও ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলাে হুদা।

হুদার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি গুলি করা মেজর নূর শেখ কামালের। বন্ধু ছিলাে বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী এবং বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ মুহিতুল ইসলাম। নূর জেনারেল ওসমানীর এডিসি ছিলাে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় ১২ নম্বর থিয়েটার রােডে ওসমানীর অফিসে নূরের সঙ্গে তার পরিচয়।।

‘শেখ কামালের বন্ধু হিসেবেও নূর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসতাে,’ বলে জানান মুহিতুল।

একইভাবে মেজর ডালিমও অনেকবার বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এসেছে বলে তিনি জানিয়েছেন। বেতারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা ঘােষণা করে ৩২ নম্বরে উপস্থিত হয় মেজর ডালিম। সেসময় মেজর ফারুকও ট্যাংকে চড়ে সেখানে উপস্থিত হয়।

পঁচাত্তর সালের ২ আগস্ট পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বাহিনীর ইন-চার্জ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এই মেজর ফারুকেরও ছিলাে নিয়মিত উপস্থিতি।

এটাকে অবশ্য তার দায় এড়ানাের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক। আদালতে দেওয়া এক লিখিত বিবৃতিতে তার দাবি ছিলাে, ইন্দিরা গান্ধীকে যেভাবে তার নিজের নিরাপত্তাকর্মীরা হত্যা করেছে, চাইলে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বাহিনীর ইন-চার্জ হিসেবে তার পক্ষেও সেটা সম্ভব ছিলাে।।

একুশ বছর ধরে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী হিসেবে দাবি করে আসলেও বিচারের মুখােমুখি হওয়ার পর এভাবে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেওয়া তার ভিডিও সাক্ষাতকারও অস্বীকার করেছিলাে ফারুক।

মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং যুক্তিতে অবশ্য প্রমাণিত হয়েছে, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার। সময়ের চেয়ে ট্যাংক রেজিমেন্ট হিসেবে ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব নেওয়ার পরই ফারুক রাষ্ট্রপতিকে হত্যার সুযােগ নিয়েছে। সঙ্গে পেয়েছে তার ভায়রা ভাই টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার কর্নেল রশিদকে।

সবার শেষে হত্যা করা হয় শিশু রাসেলকে

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে পরে গােয়েন্দারা মরদেহগুলাের ছবি তােলা ছাড়া, আর সেনাবাহিনীর মূল ধারা। দাফনের ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোনাে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

সেনাপ্রধান যখন নিজের বাসভবন আর অফিসে ছুটোছুটি করছেন, উপ-প্রধান শেভ করছেন আর ব্রিগেড কমান্ডার কিংকর্তব্যবিমূঢ়; তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সব শেষ। শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে। হত্যাযজ্ঞের শুরু, আর শেষ শিশু শেখ রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে।

হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে ওই সকালের নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞের চিত্র ফুটে উঠেছে। খুনিদের নির্মমতার যে চিত্র তাদের বর্ণনায় পাওয়া যায়, তার নজির ইতিহাসে আর নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের যখন পানি পানি’ বলে চীঙ্কার করছিলেন; তখন আরেক দফা গুলি করে তাকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। আর দশ বছরের শিশু রাসেলকে হত্যা করা হয় মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে।

দোতলায় হত্যাযজ্ঞ শেষে রাসেল এবং বাড়ির কাজের ছেলে আব্দুর রহমান রমাকে যখন নীচে নিয়ে আসা হয় তখন রাসেল এরইমধ্যে হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ মুহিতুল ইসলামকে বলেছিলাে: ভাইয়া, আমাকে মারবে না।

তাে? এরকম শিশুকেও নিশ্চয়ই খুনিরা মারবে না আশায় মুহিতুল ইসলাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন: , ভাইয়া, তােমাকে মারবে না।

বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পি,এ এবং মামলার বাদী ও এক নম্বর সাক্ষী মুহিতুল ইসলাম আরাে জানান, এরপর একজন আর্মি তার কাছ থেকে রাসেলকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।

মুহিতুল ইসলাম ছাড়াও মামলার দুই নম্বর সাক্ষী রমা, তিন নম্বর সাক্ষী মশালচি সেলিম ওরফে আব্দুল এবং চার নম্বর সাক্ষী হাবিলদার কুদ্স শিশু রাসেলকে হত্যার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন।

হাবিলদার কুদুস জানান: মেজর আজিজ পাশা অয়্যারলেসে কথা। বলছিলাে। তখন রাসেল মায়ের কাছে যাবে বলে কান্নাকাটি করছিলাে। মেজর আজিজ পাশা ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে নির্দেশ দিয়ে। বলে, শেখ রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাও।

“ওই হাবিলদার শেখ রাসেলকে তার হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলি এবং সেখান থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যায়। আর ওই হাবিলদার নীচে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলে: স্যার, সব শেষ।’ এভাবেই রাসেলকে হত্যার বর্ণনা দেন সাক্ষী কুন্দুস।

এর আগে আজিজ পাশা এবং রিসালদার মােসলেমউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বেডরুম বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী এবং শেখ কামালের স্ত্রীকে হত্যা করে বলে ওই সাক্ষী জানান।

মুহিতুল ইসলাম, রমা, মশালচি সেলিম, হাবিলদার কুন্দুস, সুবেদার গণি এবং হাবিলদার সােহরাব আলীসহ সাক্ষীদের বক্তব্যে জানা যায়, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সেদিন হত্যাকাণ্ডের শুরু শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে। প্রথম দফা আক্রমণের পর প্রেসিডেন্টের সহায়তায় সেনাবাহিনী এসেছে আশা করে শেখ কামাল সেনা দলকে ভেতরে ডাকার পরই ক্যাপ্টেন হুদা তাকে গুলি করে। শেখ কামাল নিজের পরিচয় দিলে তার উপর ব্রাশফায়ার করে হুদা।

এর আগেই মিন্টো রােডের মন্ত্রিপাড়ায় আব্দুর সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলার খবরে ঘুম ভাঙে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব সদস্যের। তার বর্ণনা দিয়েছেন উনসত্তর সাল থেকে ওই পরিবারে কাজ করা, একাত্তরেও ওই পরিবারের সঙ্গে থাকা মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী আব্দুর রহমান রমা।

তিনি জানান; আনুমানিক ভাের ৫টার দিকে হঠাৎ বেগম মুজিব দরােজা খুলে বাইরে এসে বলেন, দুস্কৃতকারীরা সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ করেছে। দ্রুত লেকের পাড়ে গিয়ে দেখি কিছু আর্মি গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসছে। বঙ্গবন্ধুকে তখন পি.এ এবং রিসেপশনিস্টের রুমে কথা বলতে দেখি। দােতলায় উঠে দেখি বেগম মুজিব ছােটাছুটি করছেন। তিন তলায় গিয়ে আর্মিরা বাসা আক্রমণ করেছে বলে শেখ কামালকে ঘুম থেকে উঠাই। কামাল দ্রুত একটা শার্ট এবং প্যান্ট পরে নীচের দিকে চলে যান। তার স্ত্রী সুলতানা কামাল দোতলায় আসেন। দোতলায় একইভাবে শেখ জামালকে ঘুম থেকে উঠাই। শেখ জামালও দ্রুত শার্ট-প্যান্ট পরে মায়ের রুমে যান, সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। তখন খুব গুলি হচ্ছিলাে। এই পর্যায়ে শেখ কামালের আর্তচৎকার শুনতে পাই।

এর আগেই বঙ্গবন্ধু নীচে নেমে আবার দোতলায় চলে এসেছিলেন। গুলি থামলে তিনি তার রুম থেকে বের হওয়ামাত্র আর্মিরা তাকে তার বেডরুমের সামনে ঘিরে ফেলে।

রমা জানান: বঙ্গবন্ধু তাদের বলেন, তােরা কি চাস? কোথায় নিয়া। যাবি আমাকে? তারা তখন বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাে। দুই/তিন ধাপ নামার পর নীচের দিক থেকে আর্মিরা গুলি করে।

বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাবার সময় তিনি আহত অবস্থায় মশালচি সেলিম ওরফে আব্দুলকে আহত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে সেনা সদস্যদের বলেন, এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকে আমাদের এখানে থাকে, একে কে গুলি করলাে?

সেলিম জানান। ওই সময়ে ও তার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সেনা সদস্যদের বলেন, তােরা আমাকে কোথায় নিয়া যাবি? কি বলবি? বেয়াদবি করছ ক্যান? এর কিছুক্ষণ পরই সিঁড়ির দিক থেকে। বঙ্গবন্ধুর ওপর গুলি।

বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা সেনা কর্মকর্তাদের পরিচয় জানিয়েছেন মামলার চার নম্বর সাক্ষী এবং নিরাপত্তারক্ষী হাবিলদার কুন্দুস। তিনি বলেছেন: মেজর মুহিউদ্দিন তার ল্যান্সারের ফোর্স নিয়ে গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দোতলার দিকে যায়। পরে কয়েকজন ফোর্স নিয়ে দোলার দিকে যায় ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর। যাবার সময় তাদেরকেও পেছন পেছন যেতে হুকুম দেয়।

তিনি জানান: ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর নূর যখন সিড়ির চৌকির ওপরে, তখন আগেই দোতলায় যাওয়া। মেজর মুহিউদ্দিন ও তার ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে নিচের দিকে নামিয়ে আনছিলাে। মেজর নূর ইংরেজিতে কিছু বললে মেজর মুহিউদ্দিন এবং তার ফোর্স একপাশে চলে যায়। এই সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, তােরা কি চাস? সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর নূর স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। সিড়ির ওপর লুটিয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু, সেসময়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

শুধু জাতির জনক নন, সেদিন আসলে পুরাে জাতিই লুটিয়ে পড়েছিলাে।

আব্দুর রহমান রমা জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলংকজনক এ হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন। সেসময় আর্মিরা তার পরিচয় পেয়ে তাকে ভেতরে যেতে বলে। তিনি বেগম মুজিবের বাথরুমে আশ্রয় নেন। বেগম মুজিবকে তখন তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক খবরটি জানিয়ে রমা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেছে।

ওই বাথরুমে শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রােজি, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব এবং বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসেরও ছিলেন। সেখানে আশ্রয় নেওয়ার আগেই শেখ নাসেরের হাতে। গুলি লাগে। তার হাত থেকে তখন রক্ত ঝরছিলাে। ‘বেগম মুজিব তার শাড়ির আঁচল ছিড়ে রক্ত মুছে দেন, ‘ বলে জানিয়েছেন রমা।

এরইমধ্যে অবশ্য ঘাতকদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, পুরাে পরিবারকেই মেরে ফেলতে হবে। ঘাতকরা। তখন আবার দোতলায় আসে। তারা দরােজায় আঘাত করতে থাকলে বেগম মুজিব ‘মরলে সবাই একসাথেই মরবাে’ বলে দরােজা খুলে দেন বলে সেখানে আশ্রয় নেওয়া রমা জানিয়েছেন।

রমা বলেন: বেগম মুজিব দরােজা খুললে আর্মিরা রুমের ভেতর ঢুকে শেখ নাসের, শেখ রাসেল, বেগম। মুজিব এবং তাকে নীচের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাে। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে বেগম মুজিব বলেন, আমি নামবাে না। আমাকে এখানেই মেরে ফেলাে। এমন কথার সঙ্গে বেগম মুজিব কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বলে। জানান আরেক সাক্ষী হাবিলদার কুন্দুস।

সেনা সদস্যরা তখন বেগম মুজিবকে আবার দোতলার রুমের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে সুলতানা কামাল রােজি জামাল ছাড়াও শেখ জামাল ছিলেন। একটু পর সেখান থেকে গুলির শব্দ পাওয়া যায়, সঙ্গে আর্তচকার।।

ওই রুমে হত্যাকাণ্ড চলার সময় অন্য ঘাতকরা শেখ নাসের, শেখ রাসেল এবং রমাকে নিয়ে নীচে নামে। গুলিতে আহত মশালচি সেলিম ওরফে আব্দুলকেও নীচে নামিয়ে আনা হয়।

নীচে নেমে রমা সাদা পােষাকের একজন পুলিশ সদস্যের লাশ দেখেন। তিনি স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান। মুহিতুল ইসলাম জানিয়েছেন, শেখ কামালকে ব্রাশ ফায়ার করা হলে এস,আই সিদ্দিকুর রহমান এবং ডি এসপি নুরুল ইসলামের (তিনিও মামলার সাক্ষী) শরীরে গুলি লাগে। ওই দু’জন এবং আরেকজন পুলিশ অফিসার পেছনের দরােজা দিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলে মেজর হুদা তাদের চুল ধরে টেনে তুলে এবং গেটের সামনে লাইনে দাঁড় করায়। পুলিশের লােক ছাড়াও টেলিফোন মিস্ত্রি । আব্দুল মতিনও ওই লাইনে ছিলেন। হঠাৎ একজন অস্ত্রধারী আর্মি এসে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসারকে গুলি করে। গুলিতে তিনি মারা যান। কয়েকজন সেনাসদস্যকে তাদের পাহারায় রেখে ওই দলটি গুলি করতে করতে উপরে চলে যায়।

এই দলটিসহ অন্যরা উপরে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে বেঁচে থাকা শেষ ক’জনসহ নীচে নেমে আসে। তখনাে বেঁচে থাকাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের এবং ছােট ছেলে শেখ রাসেল।

রমা জানান, সেনা সদস্যরা শেখ নাসের, শেখ রাসেল এবং তাকে নীচে এনে লাইনে দাঁড় করায়। শেখ নাসেরকে জিগগেশ করে তুমি কে? শেখ নাসের তার পরিচয় দিলে নীচতলার বাথরুমে নিয়ে যায়। একটুপর ওই বাথরুমে গুলি এবং সেখান থেকে “মাগাে বলে চীৎকার শুনতে পান রমা।

আরেকটু বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে মুহিতুল ইসলাম জানান: শেখ নাসেরকে যখন লাইনে দাঁড় করানাে হয় তখন তার হাত গুলিতে রক্তাক্ত জখম ছিলাে। শেখ নাসের বলেন, স্যার, আমি তাে রাজনীতি করি না। কোনােরকমে ব্যবসা করে খাই। তখন একজন সেনা কর্মকর্তা বলে, শেখ মুজিব ইজ বেটার দ্যান শেখ নাসের।

“আর যে অস্ত্রধারী আর্মি শেখ নাসেরকে নীচে নামিয়ে এনেছিলাে, সে বলে, ঠিক আছে। আপনাকে কিছু বলবাে না। আপনি ওই কক্ষে গিয়ে বসেন। এই বলে অফিসকক্ষ সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে শেখ নাসেরকে গুলি করে। শেখ নাসের পানি পানি বলে চীষ্কার করতে থাকলে আর্মিদের একজন পাহারারত আরেকজনকে বলে, যা, পানি দিয়া আয়। সে গিয়ে পানির পরিবর্তে আবারাে শেখ নাসেরকে গুলি করে, বলে জানান মুহিতুল ইসলাম।

এরপর মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে শিশু রাসেলকেও হত্যা করা হয়। এভাবে সেনাপ্রধান, উপসেনাপ্রধান, সিজিএস এবং ব্রিগেড কমান্ডারসহ অন্যদের তখন পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ চেষ্টার মধ্যেই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সকলকে কোনােরকম বাধা ছাড়াই হত্যা করে সেনাবাহিনীর ল্যান্সার এবং আর্টিলারির একটি অংশ।

সেদিন ৩২ নম্বরে ছুটে এসেছিলেন শুধু একজন

খুনিদের বাইরে সেনাবাহিনীর প্রথম যিনি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর পৌঁছেছিলেন, তিনি ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট। তাকে বাড়ির পরিস্থিতি দেখে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলাে। এরপর যারা যান তারা ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) সদস্য। তাদের সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিলাে শুধুই ঘটনাস্থলের ছবি তোলা।

তার কিছু পর সেখানে পৌঁছান কুমিল্লার ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারির যে কোম্পানিটি ৩২ নম্বরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলাে তাদের কমান্ডার ক্যাপ্টেন (পরে লে. কর্নেল) বাশার।

এরপর সেখানে উপস্থিত হন সাপ্লাই অ্যান্ড ট্রান্সপাের্ট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক যিনি পরে মরদেহগুলাের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন। আর সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর নির্দেশে বেলা ৩টার দিকে পৌঁছান ঢাকার স্টেশন কমাল্ডার।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে, ৭৫’র ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর ছােট একটি অংশ সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও ভয়ে কম্পমান সেনা নেতৃত্ব তাৎক্ষণিক কোনাে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে।

নানা জুজুর অজুহাতে এভাবে শুধুমাত্র ঘটনাস্থলের ছবি তােলা আর মরদেহগুলাের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করার মধ্যেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।

তাদের বাইরে ঘটনার পরে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি এবং তিন এডিসি। আর ঘটনার সময় শুধু একজনই সেখানে পৌঁছানাের চেষ্টা করেন এবং নিহত হন। তিনি রাষ্ট্রপতির বিদায়ী প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল। তার হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন তার ড্রাইভার এবং মামলার ২০ নম্বর সাক্ষী আইনউদ্দিন মােল্লা।

কর্নেল জামিল হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হওয়া শেষ তিনজনের একজন। অন্য দু’জনের মধ্যে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ হতচকিত অবস্থায় উদ্যোগহীনতা প্রত্যক্ষ করলেও কোনাে ব্যবস্থা নিতে পারেন নি।

আর একেবারে শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহিউদ্দিনের পক্ষে রণসজ্ঞার বিরুদ্ধে কোনাে কিছু করার কথা ছিলাে ভাবনারও অতীত।

আইনউদ্দিন মােল্লা জানান, ভাের ৫টার দিকে তার রুমের কলিং বেল বেজে উঠে। তখন তিনি অজু করছিলেন। তাড়াতাড়ি বাসার সামনে গেলে কর্নেল জামিল উপর থেকে দ্রুত গাড়ি তৈরি করতে এবং গণভবনে গিয়ে সকল ফোর্সকে হাতিয়ার ও গুলিসহ ৫ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ জানাতে বলেন।

গণভবনে সৈনিকদের নির্দেশ জানিয়ে তিনি ফিরে আসলে কর্নেল জামিল তার ব্যক্তিগত গাড়িতে রওনা হন। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রােডের মাথায় তারা গণভবন থেকে আসা ফোর্সদের দেখেন।

সেনাবাহিনী থেকে ১৯৭৪ সালে অবসরে গিয়ে কর্নেল জামিলের গাড়িচালক হওয়া মামলার ২০ নম্বর এই সাক্ষী বলেন, সােবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌছালে দক্ষিণ দিক থেকে শোঁ শোঁ করে গুলি আসতে থাকে। তখন ফোর্স অ্যাটাক করানাের কথা বললে কর্নেল জামিল বলেন, এটা ওয়ার-ফিল্ড নয়, ফোর্স অ্যাটাক করালে সিভিলিয়ানদের ক্ষতি হতে পারে।

এরপর জামিল আইনউদ্দিন মােল্লাকে প্রতিপক্ষের অবস্থান জেনে আসার নির্দেশ দিয়ে গাড়িতেই বসে থাকেন। নির্দেশ পেয়ে তিনি যখন দেয়াল ঘেঁষে ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ৫/৬ জন। সেনাসদস্য দৌড়ে জামিলের গাড়ির দিকে যায়। হাতে ইশারা করে তিনি কর্নেল জামিলকে সরে যেতে বলেন। স্যার , স্যার বলে আওয়াজও করেন কয়েকবার। কিন্তু কর্নেল জামিল তার দিকে তাকান নি।

“ওইসময় আর্মির অস্ত্রধারী লােকগুলাে গাড়ির কাছে পৌঁছে যায়। কর্নেল জামিল দুই হাত উঠিয়ে তাদেরকে কিছু বলার বা বােঝানাের চেষ্টা করেন। কিন্তু, তারা কর্নেল জামিলকে ২/৩টি গুলি করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান, বলে জানান আইনউদ্দিন মােল্লা।

পরে সকাল ৮টার দিকে কর্নেল জামিলের ছােট ব্যক্তিগত গাড়িতে করেই জামিলের মরদেহ ৩২ নম্বরে নিয়ে আসা হয় বলে মুহিতুল ইসলামসহ একাধিক সাক্ষী জানিয়েছেন।

মামলার সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে খবর পেয়েই ৩২ নম্বরের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন কর্নেল জামিল। আর হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর ওই খবর পেয়ে রাষ্ট্রপতির মিলিটারি। সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশরুল হকসহ বঙ্গভবন থেকে ৩২ নম্বরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন রাষ্ট্রপতির দুই এডিসি গােলাম রব্বানী মােমলা চলার সময় কমান্ডার এবং ডিজিএফআই’র পরিচালক) এবং ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে অবসর)। পনেরাে নম্বর সাক্ষী হিসেবে গােলাম রব্বানী জানান: ৩২ নম্বর রােডের মাথায় সেনা সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। একজন সুবেদার তাদের চশমা, ঘড়ি, মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। তিনজনকে রশি দিয়ে বেঁধে একটি নার্সারিতে বসিয়ে রাখে। কিছুক্ষণ পর তাদের চোখ বেঁধে ফেলা হয়। সেসময় গান লােডের শব্দও পান তারা।

প্রায় ২৩ ঘণ্টা পর একজন অফিসারের নির্দেশে তাদের চোখ খুলে দেওয়া হলে তারা মেজর ফারুককে দেখতে পান বলে গােলাম রব্বানী জানিয়েছেন। পরে তারা জানতে পারেন, গান লােড করে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাে রিসালদার মােসলেমউদ্দিন। কিন্তু সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট (পরে মেজর) শহিদুল্লাহ মেজর ফারুকের সঙ্গে দেন-দরবার করে তাদের মুক্তির ব্যবস্থার করেন।

মুক্তির পরও অবশ্য তাদেরকে কড়া পাহাড়ায় গণভবনে এডিসির রুমে বসিয়ে রাখা হয়। পরে রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটরি মাশররুল হকের নির্দেশে দুই এডিসি আর্মি হেডকোয়ার্টারের মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল নাসিম (পরে সেনাপ্রধান) এর কাছে রিপাের্ট করেন। হাই কমান্ডের নির্দেশে বিকেল ৪টার দিকে তারা বঙ্গভবনে গেলে খন্দকার মুশতাক আহমেদকে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে থাকতে দেখেন।

ওইদিন বিকেলে ডিজিএফআই’র নির্দেশে বঙ্গভবনে গিয়ে একইরকম দৃশ্য দেখার আগে ধানমণ্ডি গিয়েছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় ডিজিএফআই থেকে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ডিউটি ছিলাে। হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে রেডিও স্টেশন ঘুরে তিনি মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার রউফের কাছে রিপাের্ট করেন। রউফের নির্দেশে তিনি প্রথমে সেনাসদরে যান। পরে সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের নির্দেশে রক্ষী বাহিনীর পরিচালক হাসানকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যান মেজর জিয়া।

তখন ডিজিএফআই থেকে কলে মুসিউদ্দৌলাহ এবং কর্নেল মাহমুদুল হাসানকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ছবি তােলার নির্দেশ দেওয়া হলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪২ নম্বর সাক্ষী জিয়াউদ্দিনও তাদের সঙ্গী হন। তারা যখন ছবি তুলতে যান তখন বেলা ১১টা। খুনিদের বাইরে তারাই প্রথম ৩২ নম্বরে পৌছেছিলেন।

এর কিছুক্ষণ পর ব্যাটালিয়ন অ্যাডজুটেন্ট বা মেজরকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে পৌছান সাপ্লাই এবং ট্রান্সপাের্ট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুর রব (পরে মেজর জেনারেল এবং মামলার ১০ নম্বর সাক্ষী)। তিনি জানান, ৩২ নম্বর রাস্তার মুখে কিছু আর্মি তাকে বাধা দিলেও পরিচয় দেওয়ার পর তাদের যেতে দেয়। সেখানে লাশ দেখে তিনি বুঝতে পারেন; গুজব নয়, মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে।

জেনারেল রব জানান, পরে রাত সাড়ে ৩টার দিকে স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার আব্দুল হামিদ (নয় নম্বর সাক্ষী) তাকে নির্দেশ দেন: তোমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির লাশ, সেরনিয়াবাতের বাড়ির লাশ এবং শেখ মনির বাড়ির লাশ যতাে দ্রুত সম্ভব ডিসপােজ অব’ করতে হবে। কোথায় কিভাবে ডিসপােজ অব করতে হবে জানতে চাইলে কর্নেল হামিদ বলেন: এটা বঙ্গভবনের নির্দেশ, সব লাশ বনানী কবরস্থানে দাফন করতে হবে।

তবে তার ইউনিটের সৈনিকরা যে ১৮টি মরদেহ নিয়ে আসে, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ছিলাে না। কারাে জানাযায় অংশগ্রহণের সুযােগ না থাকায় নিজেরাই যতােদুর পেরেছেন দোয়া-দরূদ পড়ে লাশগুলাে তারা। বনানী কবরস্থানে দাফন করেন বলে জানান রব।

তাকে যিনি লাশ দাফনের ব্যাপারে বঙ্গভবনের নির্দেশনার কথা জানিয়েছিলেন, সেই কর্নেল হামিদও ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন। তিনি জানান: সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর নির্দেশে বেলা ৩টার দিকে ৩২ নম্বরের অবস্থা দেখে এসে তিনি রিপাের্ট করেন। পরে রাত ৩টার দিকে মেজর এম এম মতিন কর্তৃপক্ষের নির্দেশের কথা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ছাড়া অন্যগুলাে বনানী গােরস্থানে দাফনের কথা বলেন।

এছাড়া ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মতিয়ার রহমানের নির্দেশে পরিস্থিতি দেখে আসার জন্য সকাল পৌণে ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পৌঁছান রেজিমেন্ট অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন সাহাদৎ হােসেন খান।

সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে এর বাইরে আর যিনি ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন তিন ক্যাপেটল বাশার। তিনি মামলার ৭ নম্বর সাক্ষী। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকলেও গাড়ি না থাকায় তিনি সেখানে পৌঁছান দুপুর। ১২টা সাড়ে ১২টার দিকে।

তিনি জানান। ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট তার নেতৃত্বে কুমিল্লার ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারির ১০৫ জনের একটি কোম্পানি মেজর ফারুকের ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব বুঝে নেয়। গণভবনে জায়গা না থাকায় তিনি প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশরুরল হকের অনুমতি নিয়ে আজিমপুরের চায়না বিল্ডিংয়ে থাকতেন।

তিনি বলেন; ১৫ আগস্ট তার বাসার কাজের ছেলে দোকান থেকে ফেরত এসে জানায়, রুটি পাওয়া যাবে

; কারণ দেশে মার্শাল ল জারি হয়েছে। তখন রেডিও অন করে তিনি শােনেন: আমি মেজর ডালিম। বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে। সরকার উৎখাত করা হইয়াছে। দেশে মার্শাল-ল জারি করা হইয়াছে।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি গাড়ি পাঠানাের জন্য গণভবনে টেলিফোন করেন। গাড়ি না আসায় ব্রিগেডিয়ার মাশরুরুল। হকের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হন। পরে শুনেছেন যে তিনি বন্দি ছিলেন।

সকাল ১০টা?১০:৩০টার দিকে সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাব জোয়ার্দার জিপে বাসায় এসে জানায়, ল্যান্সারের সৈনিকরা সকাল বেলা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে। সাথে ক্যাপ্টেন হুদা ছিলাে। তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করেছে। এই ঘটনায় ল্যান্স নায়েক শামসুও নিহত হয়েছে। জোয়ার্দার আরাে বলে, স্যার যা হওয়ার হয়ে গেছে, বাতাসের উল্টোদিকে যাওয়া ঠিক হবে না, ওই সকালে জোয়ার্দারের সঙ্গে কথােপকথনের এরকম বর্ণনা দিয়েছেন বাশার।

তিনি বলেন তখন আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে চাইলে জোয়ার্দার বলে, স্যার, আপনার এখন যাওয়ার দরকার নেই। গাড়ি পাঠাচ্ছি। তখন আসবেন।।

বেলা ১২টা/১২:৩০টার দিকে গাড়ি আসলে বাশার সেখানে যান। তখন লেকের পাশে ক্যাপ্টেন হুদা তাকে বলে: স্যরি, ব্রাদার। আই কুড নট ইনফর্ম ইউ আলিয়ার ফর অবভিয়াস রিজন। ইট ওয়াজ নট পসিবল। (দুঃখিত ভাই, বিশেষ কারণে আমি তােমাকে আগে খবর দিতে পারি নি, সেটা সম্ভবও ছিলাে না)।

অন্তহীন ঘুমে পঁচাত্তরের গােয়েন্দা নেটওয়ার্ক

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মূলতঃ অংশ নেয় ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সার এবং টু ফিল্ড আর্টিলারি। এর মধ্যে মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ যে টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার ছিলাে, তা ছিলাে ৪৬ ব্রিগেডের অধীন। ঘটনার ব্রিগেডের অধীন ছিলাে ৪৬ মাস আগে ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারও ৭, পরে তা রেজিমেন্ট হেডকোয়ার্টারের অধীনে নেয়া হয়। ল্যান্সার ইউনিটটির কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মােমিন ছুটিতে থাকায় ১৫ আগস্ট ভারপ্রাপ্ত সিআইসি মেজর ফারুক।-ও ছিলাে টু বিসায়করভাবে জাতির জনক হত্যাকাণ্ডের আগে ৪৬ ব্রিগেড থেকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু তারপরও ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সার এবং টু ফিল্ড আর্টিলারির কথিত যে যৌথ নাইট প্যারেড় থেকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে কিলিং অপারেশনের জন্য যাত্রা, সেই নাইট প্যারেডে আসলে কি হচ্ছে তা ৪৬ ব্রিগেড এবং সেনাসদরের অজানা থাকার কথা ছিলাে না।

এমনকি যে দু’ ইউনিটের ওইদিন নাইট প্যারেড় ছিলাে না, তাদেরও যে মেজর রশিদ রাত্রিকালীন মহড়ায় যােগ দিতে বলেছে, সেটা জেনেও ব্রিগেড কমান্ডার বা সিজিএস কোনাে ব্যবস্থা নেননি।

প্রসিকিউশনের ৪১ নম্বর সাক্ষী ব্রিগেডিয়ার এ কে এম শাহজাহানের বক্তব্যেই তা স্পষ্ট। ঘটনার সময় ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের টু-আইসি ছিলেন তিনি। কমান্ডিং অফিসার চৌধুরী খালেকুজ্জামান ছুটিতে থাকায় তিনি ভারপ্রাপ্ত সি,ও ছিলেন। তাদের অবস্থান ছিলাে জয়দেবপুরে। ১৪ আগস্ট তাদের রেজিমেন্টের অ্যামবুশ ডেমােনেস্ট্রেশন ছিলাে। ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার সাফায়েত জামিল, ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং সিজি এস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টার দিকে অ্যামবুশ ডেমােনেস্ট্রেশন শেষ হয়। শাহজাহান জানান; ডেমােনেস্ট্রেশন শেষ হওয়ার পর টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ তার কাছে এসে তার ট্রপস নিয়ে রাতে নিউ এয়ারপাের্টে যেতে বলে। কিন্তু ওই রাতে তার টুপসের রােড মার্চের অনুমতি ছিলাে না বলে তিনি অপারগতা জানান। তারপরও পীড়াপীড়ি করতে থাকলে তিনি ব্রিগেড় কমান্ডার সাফায়েত জামিল ও সিজিএস খালেদ মােশাররফকে বিষয়টি জানালে তারা ওই রােড মার্চে যেতে নিষেধ করেন।

বেলা ৩টার দিকে শাহজাহানের অফিসে গিয়ে মেজর রশিদ বলে, দোস্ত ইউ হ্যাভ ইনসালটেড মি। তােমাকে একটা রিকোয়েস্ট করলাম, তুমি তাে রাখলেই না, বরং সিনিয়রদের বলে দিলে।’

শাহজাহান তার ট্রুপস নিয়ে যাবে না জানানাের পাশাপাশি সিনিয়রদের বিষয়টি জানানাের পরও রশিদ চেষ্টা চালিয়ে যায়। এ কে এম শাহজাহান বারবারই অস্বীকৃতি জানালে চা পান না করেই চলে যায় রশিদ। কিন্তু মাগরিবের আগে মেজর রশিদ আবার তার বাসায় ফোন করে ট্রপস নিয়ে নিউ এয়ারপাের্ট যাওয়ার অনুরােধ জানায়। আবার ও অপারগতা জানান শাহজাহান।

কিছুক্ষণ পর সাফায়েত জামিল অ্যামবুশ ডেমােনেস্ট্রেশন শেষ করে ফোর্স গাজীপুর থেকে ইউনিটে ফেরত এসেছে কি না টেলিফোনে জানতে চান। তিন ভাগের এক ভাগ এসেছে জানিয়ে শাহজাহান বলেন, ম্যাটেরিয়েলস নিয়ে সবার ফিরতে আরাে একদিন লাগবে। টু-আইসি শাহজাহান তখন আবারাে ব্রিগেড় কমান্ডারকে রশিদের অনুরােধের কথা জানান। জবাবে সাফায়েত জামিল বলেন, তুমি যেও না, ইউ ডু ট্রেনিং অ্যাজ প্রােগ্রাম। আজ রাত ১০টা পর্যন্ত ডিসম্যান্টল করবে, বাকিটা আগামীকাল করবে।’

ইতিহাস সাক্ষী, সাফায়েত জামিলরা যখন শুধু এরকম নির্দেশনা দিচ্ছেন; তখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ক্যামােফ্লেজ হিসেবে কথিত নাইট প্যারেডের প্রস্তুতি নিচ্ছে ফারুকের বেঙ্গল ল্যান্সার এবং রশিদের আর্টিলারি ইউনিট। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তখন এরকম নাইট প্যারেডের চর্চা ছিলাে। কিন্তু নাইট প্যারেডের নামে যে বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি চলছে, অস্ত্রাগার খুলে দেয়া হয়েছে, মেজর ফারুক রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছে– সেটা বােঝার জন্য সেখানে কোনাে গােয়েন্দা কার্যক্রম ছিলাে না।

এমনকি চাকুরিচ্যুত যে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে ডিজিএফআই’র রিপোর্ট ছিলাে, তারা যে বিকেল থেকেই ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করছে, সেই তাদের উপস্থিতির সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের এবং গােয়েন্দা বিশ্লেষণ; কোনােটাই সেদিন ছিলাে না।

তখন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ছিলেন লে, কর্নেল হামিদ। নয় নম্বর সাক্ষী হিসেবে আদালতকে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সনের ১৪ আগস্ট বিকেলে টেনিস খেলার সময় লক্ষ্য করেন যে, চাকুরিচ্যুত মেজর ডালিম ও মেজর নূর টনিস কোর্টের আশপাশে ঘােরাফেরা করছে। এটা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। খেলা শেষে তিনি মেজর নূরকে জিগগেশ করেন, তােমরা কার অনুমতি নিয়ে এখানে খেলতে আসাে? জবাবে নূর জানায়, তারা জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়ে খেলতে আসে।

কর্নেল হামিদের কাছে ওই বিকেলে চাকুরিচ্যুত মেজর নূর এবং মেজর ডালিমের উপস্থিতি শুধু অস্বাভাবিক ছিলাে। কিন্তু পরদিন সকালে বেতারে ডলিমের কণ্ঠ ছিলাে পিলে চমকানাের।

উপযুক্ত গােয়েন্দা নেটওয়ার্ক থাকলে সিনিয়র অফিসারদের হয়তাে এরকম শােকের খবর শুনতে হতাে না। আগের সন্ধ্যা থেকে ফারুক-রশিদরা সবকিছু প্রায় প্রকাশ্যেই করেছে। তাদের সেসব কার্যক্রমের রিপাের্ট করার মতাে কেউ ছিলাে না। নাকি জেনেও না জানার, দেখেও না দেখার আর শুনেও না শােনার অভিনয় আছে এর মধ্যে? এরকম প্রশ্ন আছে অনেকের।

প্রসিকিউশনের ১২ নম্বর সাক্ষী ল্যান্সারের এল.ডি সিরাজ জানিয়েছেন, তাদের নাইট প্যারেডে মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন হুদা এবং আরেকজন অফিসারকে পরিচয় করিয়ে দেয় মেজর ফারুক। প্রকাশ্য ব্রিফিংয়েই মেজর ফারুক বলে, আগামীকাল ১৫ আগস্ট ইউনিভার্সিটিতে মিটিং হবে। সেই মিটিংয়ে রাজতন্ত্র ঘােষণা করা হবে। শেখ মুজিব রাজতন্ত্র ঘােষণা করবেন। আমরা রাজতন্ত্র সমর্থন করি না। এখন আমি যা বলবাে এবং আমার অফিসাররা যা বলবে তা তােমরা শুনবে (পালন করবে)।

২৪ নম্বর সাক্ষী আর্টিলারির হাবিলদার আমিনুর রহমানের সাক্ষ্য অনুযায়ী, মেজর রশিদ এবং মেজর ডালিম তাদের ব্রিফিংয়ে বলে, অনেক কষ্ট করে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করলাম। বর্তমান সরকার আমাদের মা-বােনদের ইজ্জত রক্ষা করতে পারছে না। জনগণ না খেয়ে মরছে। এই সরকারতে উৎখাত করতে হবে। 

এ দুজন ছাড়াও ল্যান্সার এবং আর্টিলারির অন্য সদস্যরা যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাতে মােটা দাগে বলা যায়। ১, নাইট প্যারেডের নামে ফারুকের ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের সদস্যরা রাতে নিউ এয়ারপাের্টে এক হয়। ২, তাদের সঙ্গে পরে যােগ দেয় রশিদের টু ফিল্ড আর্টিলারি। ৩, সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারাও নাইট প্যারেডে যােগ দেয়। ৪, রশিদ এবং ফারুক সেনা সদস্যদের সামনে সরকার উৎখাতের আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করে। ৫, ট্যাংকের গােলা তাে ছিলােই না, শুরুতে ছােট কোনাে অস্ত্রের গুলিও তাদের ছিলাে না; কারণ মহড়ায় লাইভ অ্যামুনিশন থাকে না। ৬. কিন্তু রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে কর্নেল রশিদ এবং অন্যরা অস্ত্রাগার খুলে অস্ত্র এবং গােলা বারুদ নিয়ে যায়। ৭. নিউ এয়ারপাের্ট (বালুরঘাট) থেকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর এবং বাইরে দিয়ে খুনিরা বঙ্গবন্ধু ভবন, সেরনিয়াবাতের বাসভবন, রেডিও সেন্টারে এবং শেখ মণির বাড়িতে পৌঁছায়। ৮, সারারাত ধরেই খুনের এ প্রস্তুতি চলতে থাকে। ৯, খুনিদের প্রথম দলটি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছায় ভাের ৪টায়। এক ঘণ্টা ধরে তারা কামানসহ নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে।

কিন্তু মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স সেনাপ্রধানকে যখন খবরটি জানাতে পেরেছে, ৩২ নম্বরে তখন হামলা প্রায় শুরু হয়ে গেছে।

সেসময়ের ডিজিএফআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ ঘটনার কিছুদিন আগে মেজর ডালিম এবং মেজর নূরসহ কিছু অফিসারের সরকারবিরােধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৪। আগস্ট রাত থেকে ফারুক-রশিদের এতাে তৎপরতা, অস্ত্র-গােলাবারুদ এবং ট্যাংকসহ দুটি ইউনিটের। রাষ্ট্রপতির বাসভবনের দিকে যাওয়া, ঘণ্টাখানেক সময় ধরে রাষ্ট্রপতির বাসভবন ঘিরে অবস্থান নেয়া; এসবের কিছুই তারা জানতে পারেনি।

গােয়েন্দাদের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ৪২ নম্বর সাক্ষী মেজর জিয়াউদ্দিনের সাক্ষ্যে। ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ভাের সাড়ে ৫টায় গুলশানে | ডিজিএফআই’র অফিসার্স মেস থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হন। পথে মহাখালিতে রাস্তার আইল্যান্ডের উপর একটি ট্যাংক এবং রাস্তার পাশে খাদে আরেকটি ট্যাংক দেখতে পান।

বর্তমান জাদুঘরের কাছে গেলে ডিজিএফআই’র একজন সৈনিক এসে রেডিওতে মেজর ডালিমের ঘােষণার কথা জানান। মেজর জিয়াকে পাশের চায়ের দোকানে নিয়ে রেডি ওর সেই ঘােষণাও শােনান তিনি। এর। মানে হলাে ওইদিন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় থাকা ডিজিএফআই ইউনিট রাষ্ট্রপতির নিহত হওয়ার খবর প্রথম জানতে পারে রেডিওতে মেজর ডালিমের ঘোষণা থেকে।

১৪ আগস্ট বিকেল থেকে প্রকাশ্যেই চলে সব প্রস্তুতি

১৪ আগস্ট বিকেল থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সব প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে শেষ বৈঠক, নাইট প্যারেডের নামে সেনা সমাবেশ, অস্ত্রাগার খুলে দিয়ে অস্ত্র ও গুলি বিতরণ, রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘােষণা, সেনাদের উদ্দেশে ব্রিফিং, ট্যাংকসহ যাত্র; সবকিছু প্রকাশ্যেই হয়েছে। তারপরও যারা পারতেন, তাদের কেউই খুনিদের ঠেকাতে কোনাে উদ্যোগ নেন নি। স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে খন্দকার মুস্তাক আহম্মদ এবং মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদের মধ্যে ১৪ আগস্টের বৈঠকের বর্ণনা দিয়েছে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত খুনিদের একজন মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান। সেনাবাহিনী থেকে আগেই অবসরে যাওয়া শাহরিয়ার ওইদিন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছিলাে। বিকেলে রশিদ এবং মেজর নূর তাকে মন্ত্রী খন্দকার মুশতাকের আগামসি লেনের বাসায় নিয়ে যায়। যাবার পথে তারা। গাড়ি রেখে যায় চানখারপুলে। সেখানে তাদের মধ্যে এমন আলােচনা হয় যাতে পরদিন সকালে খন্দকার। মুশতাক তার বাসায়ই অবস্থান করে।

শাহরিয়ারের মতাে মেজর ফারুকও তার জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে যে রাজনৈতিক যােগাযােগের দায়িত্বে ছিলাে মেজর রশিদ। সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবেই পরদিন ভােরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে আগামসি লেনে শেষ বৈঠক হয় যেখানে ঠিক হয়ে যায় খন্দকার মুশতাকই হবে রাষ্ট্রপতি।

ওই বৈঠকের পর ঠিক হয় শাহরিয়ার-হুদা-নূর-রাশেদ চৌধুরীসহ চাকুরিচ্যুত অথবা অবসরে যাওয়া মেজরক্যাপ্টেনরাও ফারুকের ল্যান্সার এবং রশিদের আর্টিলারি ইউনিটের নাইট প্যারেডে যােগ দেবে, যে নাইট প্যারেড থেকে সেনা বিদ্রোহের নামে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্তরসূরীদের হত্যা করা হয়।

কর্নেল ফারুকও স্বীকার করেছে, নাইট ট্রেনিং এর সময় তাদের মধ্যে সমন্বয় করে ১৫ আগস্ট ভােরে চূড়ান্ত অ্যাকশন প্ল্যানের সিদ্ধান্ত হয়েছিলাে।

বালুরঘাটে ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতের ওই নাইট প্যারেডে স্বভাবতই প্রথমে অস্ত্র এবং গােলাবারন্দ ছিলাে না। কিন্তু রাতে যেনাে অস্ত্রাগার খুলে দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা বিকেলেই করে রেখেছিলাে টু ফিল্ড আলিরির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ২৬ নম্বর সাক্ষী, টু ফিল্ড আর্টিলারির অ্যামিউনিশন সেন্টারের দায়িত্বে থাকা নায়েক জমিরসহ একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যে তার বর্ণনা পাওয়া জামরুল জানান, ১৪ আগস্ট বিকেলে মেজর রশিদ তাকে অ্যামিউনিশন স্টোরের চাবি কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের কাছে জমা না দিয়ে নিজের কাছেই রেখে দিতে বলে।

তবে দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরসহই একটি ডজ গাড়িতে মেজর রশিদ অ্যামিউনিশন সেন্টারের সামনে আসে। তাদের সঙ্গে ল্যান্সার ও আর্টিলারির ১০/১২ জন সৈনিক ছিলাে। “মেজর রশিদের নির্দেশে অ্যামিউনিশন সেন্টারের তালা খুলে দিলে ওই সৈনিকরা কোনাে প্রকার হিসাব ছাড়াই কামানের গােলা এবং রাইফেল, স্টেনগান, এসএমজি, এল এমজি, পিস্তল, রিভলবার ইত্যাদি অন্ত্রের গুলি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়,’ বলে জানান জামরুল।

এরপর মেজর রশিদের নির্দেশে তিনি অ্যামিউনিশন সেন্টারের তালা লাগিয়ে দেন। মেজর রশিদ তখন তাকে বলে, তুমি লাইনে থাকবা। আমাদের আরাে অ্যামিউনিশনের প্রয়ােজন হতে পারে।

তবে কোথাও থেকে কোনাে বাধা না আসায় খুনিদের আর কোনাে গােলা-বারুদ বা গুলির প্রয়ােজন হয় নি। সারাদিনই কামানগুলাে নিয়ে রাজধানীতে মহড়া চলেছে, কিন্তু কোথাও থেকে কোনাে বাধা আসে নি।

ওইদিন কামানাের গােলা ব্যবহার হয়েছিলাে চারটি। এর একটি মােহাম্মদপুরে পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রথম দফা হামলার পর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মেজর মুহিউদ্দিনের নেতৃত্বে কামানের গােলা ছোঁড়া হয়। এর মাধ্যমে বােঝানাের চেষ্টা হয়েছিলাে, পুরাে সেনাবাহিনীই এই অপারেশ

রশিদ ট্রাক ভরে যে গােলা-বারুদ নিয়ে যায় সেগুলাে বালুরঘাটে নাইট প্যারেড়ে রাত ১২টার দিকে পৌছায় বলে জানান ১৭ নম্বর সাক্ষী হাবিলদার গানার সামছুল ইসলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ওই নাইট। প্যারেড শুরু হয়েছিলাে। সেখানে তখন মাত্র ছয়টি কামান থাকলেও এরইমধ্যে হাতে হাতে চলে এসেছিলাে হালকা অস্ত্র।

ছয়টি কামানের মতাে ওই রাতে ট্যাংকও ছিলাে ছয়টি। এ বিষয়ে জানান ঘটনার সময় ফাস্ট বেঙ্গল। ল্যান্সারের বি স্কোয়াড্রনের এসডিএম এবং মামলার ২৩ নম্বর সাক্ষী আব্দুল আলী মােল্লা। তিনি জানান: ১৪

আগস্ট দিবাগত রাতে নাইট ট্রেনিংয়ে গিয়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার লে. কিসমতের নির্দেশে ১০টি ট্যাংক পরিস্কার করেন। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে মেজর ফারুক এসে বলে, ট্যাংক মহড়া আছে, ট্যাংক বাইরে যাবে। যাদের ট্যাংক স্টার্ট নেয়, তারা হাত তােলাে।

ফারুকের কথায় ছয়জন ড্রাইভার হাত তুলে। তখন ওই ছয়জন ড্রাইভারকে একপাশে দাঁড় করিয়ে ট্যাংকের অন্যদের মধ্য থেকে ফারুক পছন্দ করে ফোর্স বেছে নেয়। পরে ওই ফোর্স এবং অফিসারদের মধ্যে ট্যাংক বণ্টন করে ফারুক চলে যায়। তবে তখনও ট্যাংকে কোনাে গােলা ছিলাে না।।

ফারক স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছে, পরে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের পাশে সিওডিতে অ্যামুনিশন নিয়ে এয়ারপাের্ট রােড় হয়ে চেয়ারম্যানবাড়ি রেল ক্রসিং দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে ফোর্থ এবং ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট হেডকোয়ার্টারের ভেতর দিয়ে এয়ারফোর্সের ফাইটার স্কোয়াড্রন হয়ে পুরাতন এয়ারপাের্টকে পাশে রেখে রক্ষী বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের কাছ দিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ হয়ে তারা ট্যাংক নিয়ে ৩২ নম্বরে পৌঁছায়।

ট্যাংকের গােলা পরে নেয়া হলেও ফারুকের ল্যান্সার ইউনিটকে অস্ত্র এবং গােলাবার দেওয়া হয় রাত সাড়ে ৩টার মধ্যে। এগারাে নম্বর সাক্ষী এল.ডি বশিরসহ অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যে তা স্পষ্ট হয়েছে।

চল্লিশ নম্বর সাক্ষী অনারারি ক্যাপ্টেন সাঈদ আহমেদ জানিয়েছেন, তিনি অসুস্থ থাকায় মেজর ফারুকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে এসেছিলেন। রাত ২টা/৩টার দিকে আরডিএম তার কাছে এসে বলে, আর্টিলারি আসছে, ট্যাংক রেডি হচ্ছে। দুই রেজিমেন্ট কম্বাইন্ড ট্রেনিং করবে, তাই হাতিয়ার অ্যামিউনিশন চায়। কিছুক্ষণ পর কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন দেলােয়ার তার কাছে একটা স্লিপ পাঠায়। তিনি চাবি দিয়ে স্লিপটা ট্রেজারিতে রাখতে বলেন।

কিন্তু, আধা ঘণ্টা পর তার মনে হয়, ট্রেজারিতে অনেক টাকা আছে। তখন কোয়ার্টার গার্ডে গিয়ে মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদকে কথা বলতে দেখেন তিনি। তাদের পাশে এলএমজি ফিট করা একটি জিপ ছিলাে। মেজর ফারুক তাকে গেট বন্ধ করে দিয়ে রেজিমেন্টের দিকে খেয়াল রাখতে বলে।

ফারুকের কাছে অনারারি ক্যাপ্টেন সাঈদ তাদের গন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক বলে, স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করতে যাবাে।

“এই খবর শফিউল্লাহ সাহেব জানেন? জিগগেশ করলে ফারুকের উত্তর ছিলে: দরকার মনে করি না।

এভাবে প্রকাশ্যে সব প্রস্তুতির পাশাপাশি ফারুক-রশিদের ঘােষণাও ছিলাে প্রকাশ্য। ঊনচল্লিশ নম্বর সাক্ষী রিসালদার মনসুর বলেন, নাইট প্যারেডে ফারুক বলে, বিশেষ কাজে দেশের জরুরি পরিস্থিতিতে ট্যাংক বাইরে যাবে। তােমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করাে। এই নির্দেশ পেয়ে তিনি ট্যাংক নিয়ে অ্যামিউনিশন স্টোরে যান। কিন্তু সেখানে অ্যামিউনিশন পাওয়া যায় নি। পরে ফারুক তা যােগাড় করতে পারলেও কোনাে বাধা না। থাকায় ব্যবহার করতে হয় নি।

প্রসিকিউশনের ১২ নম্বর সাক্ষী ল্যান্সারের এল,ডি সিরাজ জানিয়েছেন, প্রকাশ্য ব্রিফিংয়েই মেজর ফারুক বলে, আগামীকাল ১৫ আগস্ট ইউনিভার্সিটিতে মিটিং হবে। সেই মিটিংয়ে রাজতন্ত্র ঘােষণা করা হবে। শেখ মুজিব রাজতন্ত্র ঘােষণা করবেন। আমরা রাজতন্ত্র সমর্থন করি না। এখন আমি যা বলবাে এবং আমার অফিসাররা যা বলবে তা তােমরা শুনবে (পালন করবে)’।

২৪ নম্বর সাক্ষী আর্টিলারির হাবিলদার আমিনুর রহমানের সাক্ষ্য অনুযায়ী, মেজর রশিদ এবং মেজর ডালিম তাদের ব্রিফিংয়ে বলে, অনেক কষ্ট করে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করলাম। বর্তমান সরকার আমাদের মা-বােনদের ইজ্জত রক্ষা করতে পারছে না। জনগণ না খেয়ে মরছে। এই সরকারতে উৎখাত করতে হবে। 

চেীদ্দ নম্বর সাক্ষী দফাদার জব্বার মধা এবং ১৯ নম্বর সাক্ষী দফাদার সহিদুর রহমানসহ অন্যদের সাক্ষ্যে জানা যায়, মেজর ডালিমরা এরকম ব্রিফিংয়ে যােগ দেওয়ার আগেই তাকে এবং বরখাস্ত কিংবা অবসরে। যাওয়া অন্য কর্মকর্তাদের ইউনিফর্ম সরবরাহ করা হয়।

সব প্রস্তুতির পর কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে আর্টিলারি এবং ল্যান্সাররা বালুরঘাট থেকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর এবং বাইরে দিয়ে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর, মিন্টো রােডে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবন, ধানমণ্ডিতে শেখ মণির বাসভবন, শাহবাগে বেতার ভবন এবং বঙ্গভবনে পৌঁছে যায়। পরের ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে তিনটি বাড়িতে সংঘটিত হয় ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ড।

ডালিমের স্টেনগান দেখে ভয়ে রাস্তা ছেড়ে দেন অফিসাররা

পরের দেড় দশক বীরদর্পে বাংলাদেশ শাসন করা সেনা কর্মকর্তারা ৭৫’র ১৫ আগস্ট মেজর রশিদ আর মেজর ডালিমের স্টেনগানের সামনে শুধু মিউমিউই করেন নি, ভয়ে পালিয়েও গিয়েছিলেন। এমনকি সেনাপ্রধান কিংবা পরে ২ নভেম্বর পাল্টা কুয়ের মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের জন্য বঙ্গভবনের দখল নেওয়া সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ও ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলও ১৫ আগস্ট সকালে কোনােকিছু করার সাহস পান নি। মেজর ডালিমের স্টেনগানের সামনে অফিসারদের অবস্থা কিরকম ছিলাে সেটা বােঝা যায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৯ নম্বর সাক্ষী লে. কর্নেল হামিদের সাক্ষ্যে। সেসময় ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ছিলেন তিনি।

প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি জানান, টেনিস খেলার সময় চাকুরিচ্যুত মেজর ডালিম এবং মেজর নূরকে তারা টেনিস কোর্টের আশপাশে ঘােরাফেরা করতে দেখতেন। এটা তাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতাে। কারণ, তারা ছিলাে চাকুরিচ্যুত অফিসার। একদিন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ তাকে (হামিদকে) বলেন, এরা। চাকুরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার। এরা কেনাে এখানে খেলতে আসে! এদেরকে জানিয়ে দেবেন, এরা যেনাে না। আসে।

খেলা শেষে মেজর নূরকে কর্নেল হামিদ জিজ্ঞেস করেন, তােমরা কার অনুমতি নিয়ে এখানে খেলতে। আসাে? জবাবে নূর জানায়, জিয়ার অনুমতি নিয়ে তারা খেলতে আসে। বিষয়টি নিয়ে যে আর কোনাে কিছু করা হয়নি তার প্রমাণ কর্নেল হামিদের সাক্ষ্য, যেখানে তিনি জানান: ১৪ আগস্ট বিকেলেও টেনিস খেলার সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে মেজর ডালিম এবং মেজর নূর টেনিস কোর্টের আশপাশে ঘুরঘুর করছে।

মেজর মহিউদ্দিনসহ এই মেজর হুদা দিন ভােরে বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি করে। আর মেইন ডালিম বেতার থেকে ঘােষণা দেয়: স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।

কালাে সেই সকালের বর্ণনা দিয়ে লে. কর্নেল হামিদ জানান: ১৫ আগস্ট ভােরে অনুমান সকাল ৬টায় কর্নেল আব্দুল্লাহর টেলিফোন পেয়ে রেডিও অন করে তিনি মেজর ডালিমের কণ্ঠে শােনেন যে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।

তিনি চমকে উঠে তাড়াতাড়ি অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় জেনারেল শফিউল্লাহ টেলিফোনে বলেন: ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্টিলারি আর্মাররা বাইরে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তােমরা কি কিছু জানাে? তিনি জানি না বলে রেডিওতে কি শুনছেন সেটা বলেন। “যদি কিছু থাকে তা হলে জানাবাে,’ বলে তিনি অফিসের উদ্দেশে রওনা হন।

পরে লে, কলে নূর উদ্দিনের অফিসের সামনে জিপ থেকে নেমে তিনি বেঙ্গল ল্যান্সারের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মােমিনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

তখনকার বর্ণনা দিয়ে কর্নেল হামিদ বলেন: এমন সময় কালাে পােষাক পরা কিছু সৈনিকসহ দুটি জিপ শাে-শাে করে প্রধান গেট দিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টারে ঢুকে পড়ে। কর্নেল মােমিন হাত দিয়ে ইশারা করে। একটি জিপকে থামতে বলে। সঙ্গে সঙ্গে জিপ থেকে উন্মুক্ত স্টেনগান হাতে মেজর ডালিম নেমে পড়ে এবং চীৎকার করে বলে: শাট আপ, গেট অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার।।

* এতে তখন এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অফিসাররা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে যে যেদিকে পারলাে, ছুটে পালালাে,’ উল্লেখ করে হামিদ জানান: মেজর ডালিম সশস্ত্র অবস্থায় সরাসরি জেনারেল শফিউল্লাহর রুমে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ পর মেজর ডালিম স্টেনগানের মুখে শফিউল্লাহকে রমা থেকে বাইরে নিয়ে আসে। পেছনে জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ অন্য সিনিয়র অফিসাররা ছিলেন।

তিনি জানান। সেখানে অপেক্ষমান প্রথম গাড়িতে জেনারেল শফিউল্লাহ উঠেন, দ্বিতীয় গাড়িতে মেজর ডালিম সশস্ত্র অবস্থায় ছিলাে। তৃতীয় গাড়িতে জেনারেল জিয়া এবং চতুর্থ গাড়িতে মেজর ডালিমের সশস্ত্র লােকজন ছিলাে। চারটি গাড়ির কনভয় এরপর সেনা সদরের আউটার গেট দিয়ে দক্ষিণ দিকে ব্রিগেডে চলে যায়।

কর্নেল হামিদসহ অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যে স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরও সেনা সদর কিংবা ঢাকার ব্রিগেড তাৎক্ষণিকভাবে আর্মি হেডকোয়ার্টার বা ব্রিগেডের নিজস্ব নিরাপত্তায় তাৎক্ষণিক কোনাে ব্যবস্থাই নেয় নি। যারা দেশের রাষ্ট্রপতিকে সপরিবার হত্যা করতে পারে, তারা যে সেনা সদরেও নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের চেষ্টা করবে: সে কথা কেউ ভাবেনও নি। অথচ এর মধ্যেই তিন ঘণ্টা সময় পার হয়ে গিয়েছিলাে।

সেনা সদর তাই ছিলাে যে কারাে ঢুকে পড়ার মতাে মুক্ত এক অঞ্চল। যে কারণে সিনিয়র অফিসারদের অল্প কিছু সেনাসহ আসা মেজর ডালিম এবং মেজর রশিদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিলাে, কিংবা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যেতে হয়েছিলাে। সেদিন এমনই ছিলাে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়ােজনে জীবন। উৎসর্গ করার শপথ নেওয়া সেনা কর্মকর্তাদের অবস্থা।

লে, কর্নেল হামিদ যে বর্ণনা দিয়েছেন তার আগে-পরের চিত্র জেনারেল শফিউল্লাহসহ অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যেও পাওয়া যায়। জেনারেল শফিউল্লাহ ৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষ্য। দিয়েছেন।

খােলা স্টেনগান নিয়ে মেজর ডালিমের সেনা প্রধানের অফিস কক্ষে ঢুকে যাওয়ার যে কথা কর্নেল হামিদ জানিয়েছেন, তার পরের চিত্র পাওয়া যায় শফিউল্লাহর বক্তব্যে।

সেসময় তার কক্ষে ডেপুটি চীফ জেনারেল জিয়া এবং সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ বসেছিলেন। শফিউল্লাহ জানান, ৪৬ ব্রিগেড়েকে সক্রিয় করার জন্য তখন খালেদ মােশাররফকে তাগিদ দিচ্ছিলেন তিনি।

এইসময় দরােজা ধাক্কা দিয়ে মেজর ডালিম ১০/১৫ জন সৈন্যসহ সশস্ত্র অবস্থায় ঢুকে পড়ে তার দিকে অস্ত্র তাক করে বলে জানান শফিউল্লাহ। ডালিম চাকুরিচ্যুত অফিসার হলেও সেদিন ইউনিফর্ম পরা ছিলাে।

শফিউল্লাহ ডালিমকে বলেন: ডালিম, আমি এই অস্ত্র দেখে এবং ব্যবহার করে অভ্যস্ত। তুমি যদি এটা ব্যবহার করতে এসে থাকে, তা হলে ব্যবহার করাে। আর তা না হলে যদি কথা বলতে এসে থাকো, তা হলে তােমাদের সৈন্যদের অস্ত্র বাইরে রেখে আসাে।

শফিউল্লাহর ভাষ্যমতে: এরপর ডালিম তার অস্ত্রটি নিচের দিকে মুখ করে বলে, স্যার, প্রেসিডেন্ট ওয়ান্টস ইউ ইন দ্যা রেডিও স্টেশন। শফিউল্লাহ তখন বলেন, প্রেসিডেন্ট তাে মারা গেছেন। জবাবে ডালিম বলে, স্যার হউ শুড নাে খন্দকার মুশতাক ইজ দ্যা প্রেসিডেন্ট নাই। শফিউল্লাহ তখন বলেন, খন্দকার মুশতাক মে বি ইউর প্রেসিডেন্ট, হি ইজ নট মাইন। তখন ডালিম বলে, স্যার, ডােন্ট মেক মি ডু সামথিং ফর হুইচ আই ডিড নট কাম।

শফিউল্লাহর দাবি, এরপর তিনি ডালিমকে বলেন, তােমার যা খুশি করতে পারাে। আমি আমার টুপসের কাছে যাচ্ছি।

একথা বলে শফিউল্লাহ অফিস থেকে বের হয়ে ৪৬ ব্রিগেডের দিকে রওনা হন বলে তার সাক্ষ্যে। জানিয়েছেন। ডালিমও তার সৈন্য-সামন্ত এবং অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত গাড়ি নিয়ে তার পেছনে যায় তিনি উল্লেক করেন।

শফিউল্লাহ জানান, সেখানে (৪৬ ব্রিগেডে) মেজর রশিদ এবং মেজর হাফিজ তাকে রেডিও সেন্টারে যাবার জন্য চাপ দিতে থাকে। ওই জায়গার পরিবেশ দেখে হতভম্ব হয়ে আর চাপের মুখে শফিউল্লাহ বলেনঃ ‘আমি একা যাবাে না। এয়ার এবং নেভাল চীফের সঙ্গে কথা বলি।

১৫ আগস্ট রথী-মহারথীদের অসহায় আত্মসমর্পণ

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ৪৬ ব্রিগেডের অবস্থা দেখে হতভম্ব অবস্থায় সশস্ত্র মেজর রশিদের চাপের মুখে রেডিও স্টেশনে যেতে রাজি হন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ। আমি একা যাবে না। এয়ার এবং নেভাল। চীফের সঙ্গে কথা বলি,’ বলার পর তাদের খবর দেওয়া হয়, তারাও সেখানে আসেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

তার দাবি, কোনাে কাউন্টার অ্যাকশনে রক্তপাত ও সিভিল ওয়ার হতে পারে ধারণা করে তিনি মেজর রশিদ ও মেজর ডালিমের অস্ত্রের মুখে রেডিও স্টেশনে যেতে বাধ্য হন। এই সময়ের মধ্যে এয়ার এবং নেভি চীফও সেখানে পৌঁছে যান। ডলিম এবং অস্ত্রধারীরা তাদের স্কট করে।

শফিউল্লাহ জানান, রেডিও সেন্টারে ঢুকেই তিনি খন্দকার মুশতাককে বসা অবস্থায় দেখেন। তার ডান পাশে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর দাঁড়ানাে। খন্দকার মুশতাক তখন সাদা প্রিন্সকোট, মাথায় টুপি এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবি ও মাথায় সাদা কিস্তি টুপি ছিলাে।

রুমে ঢােকার পর খন্দকার মুশতাক তাকে বলে: কনগ্রাচুলেশন্স। ইওর ট্রপস হ্যাভ ডান এন এক্সিলেন্ট

রেস্ট। শফিউল্লাহ তখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, হােয়াট দ্যা রে? খন্দকার মুশতাক বলে, ইউ শুড নাে ইট বেটার।

‘ইন দ্যাট কেস লিভ ইট টু মি, বলে তিনি রুম থেকে বের হয়ে আসছিলেন দাবি করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে মে. জে. (অব.) শফিউল্লাহ বলেন, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তখন মুশতাককে বলে, স্যার, উনাকে থামান। উনার আরাে দরকার আছে।

ঠাকুরের এ কথার সঙ্গে সঙ্গে ডালিম, রশিদ এবং অপর একজন, সম্ভবতঃ মােসলেম, তাকে আটকে ভিন্ন রুমে নিয়ে যায়। সেখানে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এসে তাকে আনুগত্য স্বীকারের একটি খসড়া লিখে দেয় এবং তা শফিউল্লাহর কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়।

সেনাপ্রধানের পাশাপাশি বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানও সেদিন আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।

মামলার ৪৮ নম্বর সাক্ষী হিসেবে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, ১৫ আগস্ট ভােরবেলা জেনারেল শফিউল্লাহ তাকে ফোন করে বলেন, শুনেছেন বঙ্গবন্ধু। অ্যাসাসিনেটেড হয়েছেন? তিনি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, আর ইউ শিওর? উত্তরে শফিউল্লাহ বলেন, হ্যাঁ।

এরপর শুধু প্যান্ট-শার্ট পরে পায়ে হেঁটে তিনি জেনারেল শফিউল্লাহর বাসায় গিয়ে জেনারেল জিয়াকে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দেখেন। দুয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ খন্দকারের মতােই ক্যাজুয়াল ড্রেস পরে সেখানে উপস্থিত হন। তাৎক্ষণিক আলােচনায় তারা বুঝতে পারেন, মাত্র কয়েকটি আর্মি অফিসার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

পরে তিনি বাসায় গিয়ে ইউনিফর্ম পরে এয়ার হেডকোয়ার্টারে আসেন এবং সিনিয়র অফিসারদের ডেকে এয়ারফোর্সে সম্পূর্ণ শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ শফিউল্লাহর টেলিফোন পেয়ে তিনি ৪৬ ব্রিগেডের একটি অফিসে যান জানিয়ে এ কে খন্দকার বলেন, সেখানে মেজর ডালিম ও মেজর রশিদ সম্পূর্ণ সশস্ত্র অবস্থায় ছিলাে। তাদের সঙ্গে কালাে এবং খাকি পােষাক পরা কিছু সৈনিকও ছিলাে। সেখানকার অবস্থা ছিলাে পুরােপুরি বিশৃঙ্খল।

এ কে খন্দকার জানান, নেভি চীফও সেখানে ছিলেন। আর এর আগেই জেনারেল শফিউল্লাহকে রেডিও সেন্টারে যেতে রাজি করানাে হয়েছিলাে।

খন্দকারের দাবি: যে কয়েকটি আর্মি অফিসার সশস্ত্র অবস্থায় ছিলাে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজ্ঞানই ‘অয়্যার। অন দ্যা এজ অফ ইরেশনালিটি এন্ড টেনশন। সামান্যতম কনফ্রন্টেশন বা ডিসএগ্রিমেন্ট কুড হ্যাভ লিড টু প্রি অব কিলিং। আল্ডার দ্যা সারকামস্টেন্সেস, আই ওয়াজ ফোর্সড টু গাে টু রেডিও স্টেশন এন্ড সাে । ওয়াজ এড়িমরাল খান (নেভি চীফ)।’

তাদেরকেও শফিউল্লাহর মতাে এস্কট করে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয় জানিয়ে আনুগত্যের ঘােষণা পাঠ করতে বাধ্য হওয়ার বিষয়ে তার বক্তব্যও শফিউল্লাহর মতােই। পরের বর্ণনাও তাই। তাদেরকে এস্কট করে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে খন্দকার মুশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং অন্য কয়েকজন মন্ত্রি। হিসেবে শপথ নেয়।

রেডিও স্টেশনের মতাে শপথ অনুষ্ঠানেও জেনারেল জিয়া, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফসহ অন্য সিনিয়র। অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এড়িমরাল এম এইচ খানও শফিউল্লাহ এবং এ কে খন্দকারের মতাে অসহায় আত্মসমর্পণের কথা জানিয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে পার্থক্য যে শফিউল্লাহ এবং খন্দকার মুক্তিযােদ্ধা, আর এম এইচ খান ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত।

তিনি জানান: ১৫ আগস্ট ফজর নামাজের পর তার বাসার দক্ষিণ রাস্তার ওপারে সার্কিট হাউসের একটি বাসায় রেডিওর আওয়াজ থেকে একটি ঘােষণা শুনেন: আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে । হত্যা করা হয়েছে, আর্মি ক্ষমতা দখল করেছে।

এ খবর শােনার পর জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন করে না পেয়ে ইউনিফর্ম পরে তিনি এ কে খন্দকারের বাসায় যান। খন্দকার তখন নাইট ড্রেসে ছিলেন। খানকে খন্দকার বলেন, আপনি শফিউল্লাহর বাসায় যান, আমি আসছি। শফিউল্লাহর বাসায় গিয়ে নৌবাহিনী প্রধান একজন জওয়ান ছাড়া আর কোনাে আর্মি দেখেন নি বলে এম এইচ খান জানান। তিনি শফিউল্লাহকে ডেকে দিতে বলে বৈঠকখানায় বসেন। তখন জেনারেল জিয়াকে বাগানে ফুল ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দেখেন। একটু পর খালেদ মােশাররফ সেখানে আসেন।

জেনারেল শফিউল্লাহ প্রেসাডেন্টের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না জানিয়ে তাকে নেভাল বেস, হাজী মুহসীনে যেতে বলেন। সেখানে যাওয়ার পর তিনি আর শফিউল্লাহর অবস্থান জানতেন না। পরে অনেককে জিজ্ঞেস করে তিনি ৪৬ ব্রিগেডে পৌঁছে সেখানে খুব বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখেন।

নৌবাহিনী প্রধানের পরের বর্ণনাও সেনা ও বিমানবাহিনী প্রধানের মতো। তিনিও আনুগত্য ঘােষণার একইরকম প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে জানান, তার কণ্ঠেও আনুগত্য ঘােষণাপত্র রেকর্ড করা হয়।

তিনবাহিনী প্রধানের মতাে পুলিশ ও বিডিআর প্রধান এবং রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধানের আনুগত্যের ঘােষণা রেকর্ড করে প্রচার করা হয়।

সেসময়ের বিডিআর প্রধান মে, জে, (অব.) খলিলুর রহমান ৪৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জানান; সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আর্মির একজন ক্যাপ্টেন এসে জানায়, মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুকের একটি বার্তা আছে। বার্তাটি ছিলাে; আমরা জুনিয়ররা যা করার করেছি। আপনারা সিনিয়ররা এসে পরিস্থিতি সামলান, দেশটাকে বাঁচান। অন্য সিনিয়র অফিসাররা রেডিও স্টেশনে আছেন। আপনারাও সত্ত্ববর চলে আসুন, তাদের সঙ্গে আলােচনা করে কাজ করুন।

এরপর জেনারেল খলিল তার অফিসারদের সঙ্গে আলােচনা করে সবাই একমত হন, যেহেতু তিন বাহিনী প্রধান অনুিগত্য স্বীকার করেছেন, এই অবস্থায় তিন বাহিনীর বিপক্ষে অন্যকিছু করা গৃহযুদ্ধের সামিল হবে।

খলিলুর রহমান পরে সকাল সাড়ে ১০টা ১১টার দিকে রেডিও সেন্টারে গেলে খন্দকার মুশতাক তাকে বলে, ঘটনা যা হবার হয়ে গেছে, এখন আপনারা পরিস্থিতি সামলান, দেশকে বাঁচান।

জবাবে অন্য অফিসারদের মতাে জেনারেল খলিলুর রহমান বলেন, ‘ঠিক আছে, তাই হবে।’ এরকম বলে। তিনিও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

১৫ আগস্ট কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্রিগেড কমান্ডার

সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর অভিযােগ, ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে তিনি উপপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে কোনাে সহায়তা পান নি। এরপর ১৯ আগস্ট ফর্মেশন কমান্ডারদের কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগে ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়েত জামিল তার সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘ডু নট ট্রাস্ট ইওর ডেপুটি, হি ইজ বিহাইন্ড অল দোস থিংস।’ তবে কর্নেল শাফায়েত জামিলও ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের অভ্যুত্থানের আগে কিছু করতে পারেন নি বা করতে চান নি।

ওইসময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জানান, ১৫ আগস্ট অনুমান সকাল ৬ টায় তার সাফায়েত) বাসভবনের দরােজায় প্রচণ্ড ধাক্কার আওয়াজ শুনে দরােজা খুলে তিনি কাঁধে স্টেনগানসহ তার ব্রিগেডের অধীন টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদকে দেখেন। রশিদের সঙ্গে নিরস্ত্র অবস্থায় ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হাফিং এবং আর্মি। হেডকোয়ার্টারের অফিসার লে. কর্নেল আমিন আহম্মেদ চৌধুরী।

সাফায়েতকে দেখামাত্র মেজর রশিদ বলে, উই হ্যাভ ক্যাপচার্ড স্টেট পাওয়ার আন্ডার খন্দকার মুশতাক। শেখ ইজ কিলড। ডু নট ট্রাই টু টেক এনি অ্যাকশন এগেইনস্ট আস।

রশিদের কথা শুনে ব্রিগেড কমান্ডার হতচকিত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান বলে সাফায়েত নিজেই তার সাক্ষ্যে স্বীকার করেছেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে সাফায়েতকে ফোন করেন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ। তিনি টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কারা ফায়ার করছে তা সাফায়েত জানেন কি না। জবাবে সাফায়েত মেজর রশিদের কাছ থেকে শােনা বক্তব্য অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর জানান।

সেনাপ্রধান তখন তাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে টেলিফোনে বলেছেন, আক্রমণকারীরা সম্ভবত শেখ কামালকে মরে ফেলেছে।

সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলে সাফায়েত তার অধীনে থাকা ফাস্ট, সেকেন্ড এবং ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন কমান্ডিং অফিসারকে টেলিফোনে ব্যাটালিয়ন প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন বলে দাবি করেন।

এ তিন ইউনিটের বাইরে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া মেজর রশিদের টু ফিল্ড আর্টিলারিও তার অধীনে ছিলাে। সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা কলে সাফায়েত ড্রয়িংরুমে গিয়ে মেজর হাফিজকে পান, কিন্তু মেজর রশিদ এবং আমিন আহম্মেদ চৌধুরীকে পাননি।

এরপর তিনি দ্রুত ইউনিফর্ম পরে মেজর হাফিজসহ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা হন। তিনি জানান: রাস্তায় জেনারেল জিয়ার বাসায় গিয়ে দেখেন জিয়া শেভ করছেন। ঘটনা শােনার পর জেনারেল জিয়া বলেন, সাে হােয়াট প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড! ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার, আপহােল্ড দ্যা কনস্টিটিউশন।

জিয়ার বাসা থেকে বের হয়ে ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ঢােকার মুখে একটি ট্যাংক আক্রমণাত্বক অবস্থায় দেখতে পান বলে জানান কলে সাফায়েত। ট্যাংকের উপর মেজর ফারুক বসা ছিল। শুধু তাই নয়, মেজর ফারুক তার সাপ্লাই এন্ড ট্রান্সপাের্ট কোম্পানির সারিবদ্ধ গাড়িগুলাের উপর হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলিও করে। ফলে কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।

কর্নেল সাফায়েত ফাস্ট বেঙ্গল ইউনিটের লাইনের ভেতরের রাস্তার উপরে আরাে তিনটি ট্যাংক আক্রমণাত্মক অবস্থায় দেখতে পান। তার দাবি, তাৎক্ষণিকভাবে ওই ট্যাংকগুলাের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব ছিলাে না।

৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার সাফায়েত ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যাওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে সিজিএস। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ইউনিফরম পরে সেখানে আসেন। তিনি চিফ অব আর্মি স্টাফের বরাত দিয়ে ৪৬ ব্রিগেডের যাবতীয় অপারেশনাল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার কথা জানান বলে সাফায়েত তার সাক্ষ্যে দাৰি। করেন।

এ বিষয়ে মামলার ৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জেনারেল শফিউল্লাহ বলেছেন, তিনি সাফায়েতের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় মনে হয়েছিলাে, সাফায়েত মাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন। তিনি তখন তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন দিয়ে আর্টিলারি এবং আরমারকে প্রতিহত করার নির্দেশ দেন বলেও দাবি করেন।

শফিউল্লাহ বলেছেন, বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোনাে নড়াচড়ার আভাষ না পেয়ে তিনি সিজি এস খালেদ মােশাররফকে ৪৬ ব্রিগেড়ে গিয়ে সাফায়েত জামিলকে সহায়তা করার নির্দেশ দেন। তবে তার দাবি, সেসময় জিয়া বলেছিলেন: ডু নট সেড হিম, হি ইজ গােয়িং টু স্পয়েল ইট।

ওইসময়ের সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ একথাও বলেছেন: সকাল ৭টার দিকে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়ার পর তার অফিসে তার সামনে বসা ডেপুটি চীফ জেনারেল জিয়া বলেন, সিজিএস খালেদ মােশাররফকে আর বাইরে যেতে দিও না। বরং ইন্ডিয়ান আর্মি মাইট গেট ইন দিস প্রি-টেক্সট’ উল্লেখ করে জিয়া তাকে ‘অপস অর্ডার তৈরি করতে বলেন।

সেনাপ্রধানের দাবিমতে, সাফায়েতকে তিনটি পদাতিক ব্যাটলিয়ন তৈরি করা কিংবা খালেদ মােশাররফের দায়িত্ব নেয়া অথবা “অপস অর্ডার তৈরি করা; কোনােকিছুই সেদিন আর হয় নি।

বরং সেখানে সেনাপ্রধানকে এনে পরে আরাে দু’ বাহিনী প্রধানসহ রেডিও স্টেশনে নিয়ে খুনিরা খন্দকার মুশতাকের প্রতি আনুগত্য আদায় করে নেয়।

এভাবে সেদিন ৪৬ ব্রিগেডের একটি ইউনিট হিসেবে টু ফিল্ড আর্টিলারি এবং ৬/৭ মাস আগে ৪৬ ব্রিগেড় থেকে হেডকোয়ার্টারের অধীনে নেয়া ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের বিরুদ্ধে ৪৬ ব্রিগেডের বাকি তিনটি ইউনিট দিয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে ৪৬ ব্রিগেড এবং সেনা সদর ব্যর্থ হয়।

হত্যাকাণ্ড ঠেকানাের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মতাে খুনি অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থায় নিতেও ব্যর্থ হয় ৪৬ ব্রিগেড়।

হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থতার এক কারণ: ঘটনার কিছুসময় আগে ৪৬ ব্রিগেডের ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স সরিয়ে নেয়া। কি কারণে ব্রিগেডের মাঠ পর্যায়ের গােয়েন্দা নেটওয়ার্ক গুটিয়ে নেয়া হয় তার কোনাে ব্যাখ্যা নেই। তবে ওইসময় যে ৪৬ ব্রিগেডের নিজস্ব গােয়েন্দা ব্যবস্থা ছিলাে না সেটা স্বীকার করেছেন সাফায়েত জামিল।

তার হয়তাে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ছিলাে না। কিন্তু সেনা সদরের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স! তারাও ট্যাংককামানের ৩২ নম্বরের দিকে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারে একেবারে শেষ মুহূর্তে। আর বহুল আলােচিত। ডিজিএফআই আগে কিছু ষড়যন্ত্রের তথ্য জানতে পারলেও ১৪ আগস্ট রাত থেকে জানতে পারেনি কিছুই।

তবে, মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে ডিজিএফআই’র ওই সময়ের ঢাকা ডিটাচমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর জিয়াউদ্দিন অভিশপ্ত সেই সকালে সেনা সদর এবং রক্ষী বাহিনীর অসহায় আত্মসমর্পণের কথা জানিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪২ নম্বর সাক্ষী মেজর জিয়া বলেছেন, ১৫ আগস্ট সকালে সেনা সদরে আলােচনা হয়: যেহেতু বঙ্গবন্ধু ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে, তাই কোনাে পদক্ষেপ নিলে গৃহযুদ্ধ ও অযথা রক্তক্ষয় হতে পারে, তাই কোনাে পদক্ষেপ নেয়া সমীচীন হবে না।

তিনি আরাে জানান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ রক্ষী বাহিনীর পরিচালক মেজর হাসানকে রেডিও সেন্টারে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলে তিনি তা পালন করে হাসানকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যান।

রক্ষী বাহিনীর প্রধান তখন দেশে ছিলেন না।

তবে হাসানকে নিয়ে যাওয়ার সময় রক্ষী বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে রক্ষী বাহিনীর সদস্যদেরকে ব্যাটল ড্রেসে দেখেছিলেন মেজর জিয়া।

১৫ আগস্ট রহস্যময় ভূমিকায় জেনারেল জিয়া

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিলাে রহস্যময়। হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে, একদিকে তিনি সংবিধানকে সবার উপরে রাখার কথা বলেছেন, অন্যদিকে খুনিদের বিরুদ্ধে সেদিন কোনাে ব্যবস্থা নিতে দেননি। শুধু তাই নয়, হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহখানেক পর সেনাপ্রধান হয়ে তিনি যেমন খুনিদের যেমন খুশি কার্যক্রম চালানাের সব ব্যবস্থা করে দেন, তেমনই তাদেরকে পরে পুনর্বাসিত করেন; হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশেও অনুমােদন দেন।

একইসঙ্গে আসামীদের স্বীকারােক্তি থেকে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন জেনারেল জিয়া। সেটা বন্ধে কোনাে ব্যবস্থা তাে দূরের কথা, উল্টো তিনি তাদেরকে উৎসাহ যুগিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ঘুরেফিরেই এসেছে প্রয়াত জেনারেল জিয়ার নাম। প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে সেসময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মামলার ৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জানান তার এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানের একইরকম যােগ্যতা থাকলেও ‘বাই নম্বরে’ জেনারেল জিয়াউর রহমান

সিনিয়র ছিলেন। জেনারেল ওসমানীর পরে ১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমানের জায়গায় তাকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করা হলে তিনি (শফিউল্লাহ) নিজেই প্রতিবাদ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গেলে বঙ্গবন্ধু বলেন, তােমার কথা শুনেছি। দেয়ার ইজ সামথিং কলড পলিটিক্যাল ডিসিশন।

জবাবে শফিউল্লাহ বলেন, স্যার, ফ্রম টুডে অ্যান্ড অনওয়ার্ডস আই অ্যাম অ্যা ভিকটিম অব সারকামস্টেন্সেস। বঙ্গবন্ধু তখন বলেন, তোমরা বড় বড় কথা বলাে, যাও কাল থেকে তুমি বোনারেল ওসমানীর কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেবে।

শফিউল্লাহ অফিসে গিয়ে প্রথমেই কুমিল্লায় জিয়াউর রহমানকে ফোন করেন। টেলিফোনে তার নিয়ােগসহ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনার বিস্তারিত জানান। কথা শােনার পর জিয়া বলেন, ওকে শফিউল্লাহ, গুড বাই।

এর সপ্তাহখানেক পর একটা নতুন পদ ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ সৃষ্টি করে ওই পলে জিয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়। এই পদ পাওয়ার পরও তার। মনে ক্ষোভ থেকে যায় বলে শফিউল্লাহ বুঝতে পারতেন।

তিনি জানান: কর্নেল তাহেরও মনে করতেন, জিয়ারই আর্মি চিফ হওয়া উচিত। তাহের একদিন শফিউল্লাহর অফিসে এসে বলেন, স্যার, এতােদিন তাে চিফ অব আর্মি স্টাফ থাকলেন, এখন এই পদটা জিয়াউর রহমানের জন্য ছেড়ে দেন।

তাহেরের কাছ থেকে এরকম অপ্রত্যাশিত কথা শুনে তখনই শফিউল্লাহ তাকে বলেন, ডু ইউ নাে, ইউ আর ডাউন ক্যাটাগরাইজড? তুমি এখনই সিএমএইচে যাও এবং সসম্মানে মেডিক্যালি বাের্ড আউট হয়ে যাও। তা না হলে তােমাকে চাকুরি থেকে বহিষ্কারে বাধ্য হবাে।

শফিউল্লাহ জানান: বঙ্গবন্ধুকে এই বিষয়টি জানানাে হলে তিনিও এতে সমর্থন জানান। অবশেষে কর্নেল তাহের মেডিক্যালি অবসর গ্রহণ করেন। তাহেরের অবসরে আর্মিতে কিছু প্রতিক্রিয়া এবং অপপ্রচার হয়।

রক্ষী বাহিনী গঠন এবং রক্ষী বাহিনীকে কার্যকর করার জন্য গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হলে সামরিক বাহিনীতে অপপ্রচার এবং অসন্তোষও দেখা যায় বলে শফিউল্লাহ জানান।

তিনি বলেন: পাশাপাশি ছিলাে মেজর ডালিমের অবসরের ঘটনায় কিছু অপপ্রচার। ডালিমকে অব্যাহতি দেয়া হলে মেজর নূর সরকারের বিরুদ্ধে কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে। এ কারণে তাকেও চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিলাে। জেনারেল জিয়ার পি,এস ছিলাে মেজর নুর। তাদের অবসরেও কিছু অপপ্রচার। চলে। সেই অপপ্রচারে সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এছাড়া বেতন-ভাতা নিয়েও কিছুটা ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিলাে যার সমাধানের বদলে নীরব থেকে জেনারেল জিয়া তা কিছুটা উস্কে দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪৭ নম্বর সাক্ষী মেজর জেনারেল (অব.) খলিলুর রহমান বলেন, ১৯৭৩ সালে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পাকিস্তান থেকে ফেরত এসে দুইমাস পর বিডিআরে পরিচালক হিসেবে যােগ দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীতে তিনি ক্ষুব্ধ ভাব লক্ষ্য করেন।

“তখন সামরিক বাহিনীর জন্য আলাদা বেতন কমিশন গঠন না করার কারণে সামরিক বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছিলাে। সামরিক-বেসামরিক যৌথ বেতন কমিশনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন জেনারেল জিয়া। কিন্তু, জিয়া এই বিষয়টি বেতন কমিশনে তুলে ধরেননি, বলে জানিয়েছেন জেনারেল খলিল।

তাছাড়া, জেনারেল জিয়া নম্বরের ভিত্তিতে জেনারেল শফিউল্লাহর চেয়ে সিনিয়র থাকার পরও তাকে সেনাপ্রধান না করায় আর্মি অফিসাররা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় বলে দাবি করেছেন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় বিডিআর প্রধান এবং পরে চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ হওয়া জেনারেল খলিলুর রহমান।

সাক্ষীদের সাক্ষ্যে বােঝা যায়, সেনাবাহিনীতে এরকম অসন্তোষ এবং জিয়ার সেনাপ্রধান হতে না পারার ক্ষোভকে এক করে তাকে ব্যবহার করে মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুক।

মেজর ফারুক তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে নিজেও এরকম বলেছে: ওই সময়ে লেডিস ক্লাবে মেজর ডালিমের স্ত্রীকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গােলাম মােস্তফার ছেলের সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের কিছু অফিসার ও জওয়ান গাজী গােলাম মােস্তফার বাড়ি তছনছ করে। তাতে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে মেজর ডালিম, মেজর নূর ও আরাে কয়েকজনের চাকুরি চলে যায়। সেসময় ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মাঝে মাঝে পরিবারসহ আমার বাসায় হেঁটে হেঁটেই চলে আসতেন। তিনি দেশের পরিস্থিতি আলােচনা করতেন। একসময় বলেছিলেন, তােমরা ট্যাংক-টুং ছাড়া। দেশের আর খবরা-খবর রাখাে কি? আমি বলি যে, দেখছি তাে দেশের অনেক উল্টাসিধা কাজ চলছে। আলাপের মাধ্যমে তিনি আমাকে ইনস্টিগেট করে বললেন, দেশ বাঁচানাের জন্য একটা কিছু করা দরকার। আমি বিষয়টিকে তখন গুরুত্ব দেই নাই।

তবে, তার দাবি ১৯৭৫ সালের প্রথমদিকে বাকশাল গঠন হওয়ার পর পরিস্থিতি ভিন্নরকম হয়ে যায়।

ফারুকের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে আছে: মেজর রশিদের সাথে দেশের আবহাওয়ার পরিবর্তন সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা হতে থাকলে সিদ্ধান্ত হয় যে, একমাত্র শেখ মুজিবকে ক্যান্টনমেন্টে এনে তাকে দিয়ে পরিবর্তন করা ছাড়া দেশে কোনাে পরিবর্তন ঘটানাে যাবে না। রশিদের বাসায় এসব আলােচনাকালে তার স্ত্রী জোবায়দা রশিদও (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় প্রথমে তাকে আসামী করা হলেও পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তি পায়) উপস্থিত ছিলাে।

* এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সাথে আলােচনা হয় এবং সাজেশন চাইলে তিনি বলেন, আমি কী করতে পারি, তােমরা করতে পারলে কিছু করাে। পরে আমি রশিদের বাসায় গিয়ে জিয়ার মতামত তাকে জানাই। রশিদ তখন বলে, এই বিষয় নিয়ে তােমাকে চিন্তা করতে হবে না। এটা পলিটিক্যাল ব্যাপার। আমি ডিল করব। রশিদ পরে জিয়ার সঙ্গে এবং খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে যােগাযােগ করে, ‘বলে জানায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ফারুক।

মেজর রশিদের সঙ্গে জিয়ার আসলে কি কথা হয়েছিলাে, মৃত্যুদণ্ডে পাওয়া পলাতক রশিদ ছাড়া আর কারাে জানা নেই।

তবে মামলার ৪৪ নম্বর সাক্ষী কর্নেল সাফায়েত জামিল তার সাক্ষ্যে বলেছেন, ১৫ আগস্ট ভােরে জিয়ার। বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, জিয়া শেভ করছেন। ঘটনা শােনার পর জেনারেল জিয়া বলেন, সাে হােয়াট। প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার, আপহােল্ড দ্যা কনস্টিটিউশন।

কেউ যদি উপপ্রধানের বক্তব্যের প্রথম অংশ শােনেন যে রাষ্ট্রপতি মৃত, তাতে কি হয়েছে(!), তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে এই হত্যাকাণ্ডকে তিনি স্বাগত জানাচ্ছেন। কিন্তু পরের অংশটা শুনলে মনে হবে, সংবিধানকে উর্ধ্বে তুলে ধরে উপরাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলছেন তিনি।

তবে এখানে জিয়াকে সংবিধানের রক্ষক মনে হলেও পরে আর কোনাে কার্যক্রমে তার প্রমাণ মেলেনি। তিনি নিজে সেনাপ্রধান হয়েও সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেননি। এর আগে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহও তার কাছ থেকে কোনাে সহায়তা পাননি।

শফিউল্লাহ তার সাক্ষ্যে বলেছেন, ১৯ আগস্ট ফর্মেশন কমান্ডারদের কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগে ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়েত জামিল তার সঙ্গে দেখা করে বলেন, ডু নট ট্রাস্ট ইওর ডেপুটি, হি ইজ। বিহাইন্ড অল দোস থিংস।

এ বিষয়ে ৪৪ নম্বর সাক্ষী হিসেবে কর্নেল সাফায়েত জামিল বলেন, ২৪ আগস্ট সেনা প্রধান হলেও জেনারেল জিয়া আর্মিতে ‘চেইন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনার কোনাে চেষ্টাই করেননি। এর ফলে ৩ নভেম্বর একটি অভ্যুত্থান অত্যাবশক হয়ে পড়ে।

তিনি জানান: ১৫ আগস্টের খুনি অফিসারদের “চেইন অব কমান্ডে’ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ৩ নভেম্বর সিজিএস খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে তারা একটি সেনা অভ্যুত্থান ঘটান। ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সির ছাড়া সব ইউনিট তাদের সঙ্গে ছিলাে।

* এই অভ্যুত্থানের নেগােসিয়েশনের এক পর্যায়ে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের (২ নভেম্বর দিবাগত রাতে) জেল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অফিসার মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর পাশা, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), ক্যাপ্টেন মাজেদ, কর্নেল শাহরিয়ার, রিসালদার সারােয়ার, রিসালদার মােসলেমসহ আরাে কয়েকজন পরিবারসহ খন্দকার মুশতাকের উদ্যোগে ২ নভেম্বর রাতে দেশত্যাগ করে চলে যায়,’ উল্লেখ করে সাফায়েত বলেন, জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদের বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলােতে চাকুরি দিয়ে পুনর্বহাল করেন।

তবে মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ ওই চাকুরি নেয়নি।

তারা দু’জনই ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে আসে জানিয়ে সাফায়েত জামিল বলেন, মেজর ফারুক সাভারে, বগুড়ায় বিদ্রোহের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আর মেজর রশিদ টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব। গ্রহণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

জেনারেল জিয়া তার সময়ে অনেক অভুত্থান চেষ্টায় অনেককে ফাঁসিতে ঝুলালেও, এমনকি তাকে ক্ষমতায় আনা ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের কারণে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেও, ফারকরশিদের বিরুদ্ধে জেনারেল জিয়া কোনাে ব্যবস্থা নেননি বলে জানান কর্নেল সাফায়েত জামিল।

তবে, তিনি জানান, ১৯৮০ সালের শেষদিকে ১৫ আগস্টের খুনি অফিসাররা জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে একটি অভুত্থান ঘটানাের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে জিয়া তাদের সকলকে বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে) চাকুরিচ্যুত করেন। তখন থেকে তারা বিদেশেই ফেরারি জীবন যাপন করতে থাকে।

কিন্তু, সাফায়েত জামিল জানান, এইচ এম এরশাদ ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করে দ্বিতীয়বার তাদের পুনর্বাসন করেন এবং আগের সমস্ত বকেয়া বেতন পরিশোধ করে দেন। সেই থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সকল সরকারের আমলে তারা পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে,’ বলে সাফায়েত জানান।

তাদের মধ্যে ফারুক-রশিদ অবশ্য পরে ফ্রিডম পার্টি গঠন করে দেশেই থেকে যায়। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ফারুক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলাে। আর ১৯৯৬’র ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এমপি

হয়েছিলাে কর্নেল রশিদ। পরে ৯৬’র ১২ জুনের নির্বাচনের পর পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে রশিদ বিদেশে চলে যেতে পারে। আর কয়েক মাসের মধ্যে গ্রেফতার হয় মেজর ফারুক, মেজর সুলতান শাহরিয়ার, আব্দুল ওয়াহাব জোয়ার্দার, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লক্ষ্য করে কামান দাগানাে সেসময় পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে থাকা আর্টিলারির কর্নেল মুহিউদ্দিন।

ফারুক রহমান যারা পলাতক

রশিদ খান

বজলুল হুদা মহিউদ্দিন আহমেদ মুহিউদ্দিন আহমদ

আবদুর রশিদ

ভালিম

নূর চৌধুরী রাশেদ চৌধুরী মাজেল মােসলেম উদ্দিন

জোয়ার্দার এবং ঠাকুর অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা থেকে খালাস পায়। আর বিদেশ থেকে ফেরত আনা বজলুল হুদা ও ল্যান্সারের মহিউদ্দিনসহ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয় ফারুক, শাহরিয়ার ও মুহিউদ্দিন।

এই মুহিউদ্দিন তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর বিদেশে পাঠানাে সকল মেজরকে কূটনৈতিক মিশনে চাকুরি দেন। কিন্তু, মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক চাকুরি নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আর্মিতে পুনর্বহালের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। মেজর রশিদ, মেজর ফারুক ও মেজর ডালিম ১৯৭৬ সালে গােপনে হঠাৎ বাংলাদেশে চলে আসে এবং মেজর ফারুক সাভার সেনানিবাসে গিয়ে বেঙ্গল ক্যাভালরি (সাবেক ল্যান্সার) এর কমান্ড হাতে তুলে নেয়।

বগুড়ায় অবস্থানরত বেঙ্গল ক্যাভালরির অন্য ইউনিটের সৈনিকরাও ফারুক রহমান সেখানে না গেলে মার্চ করে ঢাকা আসবে বলে হুমকি দিলে ফারুক রহমান বগুড়া চলে যায় এবং সেখানে গিয়ে ল্যান্সার ইউনিটের কমান্ড গ্রহণ করে। জেনারেল জিয়া ফারুক রহমানকে ঢাকায় ফেরত আনেন। পরে এই অপরাধে এই ইউনিটের অনেক সৈনিকের কোর্ট মার্শালে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন, এমনকি ইউনিটটি বাতিল করে দেন। কিন্তু মেজর ফারুককে সাজা না দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেন, এভাবে ফারুকের প্রতি জিয়ার ভালােবাসার কথা জানান মুহিউদ্দিন।

তিনি বলেন: মেজর ফারুকের সঙ্গে আসা মেজর রশিদ এবং মেজর ডালিম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ড এবং কন্ট্রোল হাতে নেওয়ার চেষ্টা চালায় এবং সৈনিক লাইনে গিয়ে বিদ্রোহের উস্কানি দিতে থাকে। কিন্তু জিয়াউর রহমান তার বিরুদ্ধে কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ৩/৪ দিন পর বিদেশে ফেরত পাঠান। এতে আমার (কর্নেল মুহিউদ্দিনের) মনে হয়, ১৫ আগস্টের ঘটনায় জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিলাে যার জন্য তিনি ফারুক ও রশিদের প্রতি খুবই দুর্বল ছিলেন জেনারেল জিয়া।

শফিউল্লাহর ব্যর্থতায় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনিদের পক্ষে ওসমানী

জেনারেল শফিউল্লাহ “রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সেনাবাহিনী প্রধান হলেও ওই সিদ্ধান্ত দেওয়া রাষ্ট্রপতির চরম দুঃসময়ে প্রথম সুযােগেই তিনি পাশে দাঁড়াতে পারেননি। যে কারণে তাকেও সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরে যেতে হয়, রাষ্ট্রদূত হয়ে চলে যেতে হয় বিদেশে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সেসময়ের সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহর সাক্ষ্যে তার সেই ব্যর্থতা এবং অসহায়ত্বের কথা ফুটে উঠেছে। ওই সময়ের গােয়েন্দা ব্যর্থতার কথাও জানা গেছে তার বক্তব্যে। বােঝা গেছে, খুনিরা আগের সন্ধ্যা থেকে সাজ সাজ রবে হত্যা প্রস্তুতি নিলেও গােয়েন্দারা বিষয়টি জানতে পেরেছেন আর্টিলারি এবং ল্যান্সার সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার পর।।

শফিউল্লাহ জানান : ১৫ আগস্ট তার বেটম্যান দরােজা ধাক্কা দিলে বের হয়ে দেখেন ডিএমআই (ডিরেক্টর, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) লে. কর্নেল সালাহউদ্দিন এসেছেন। সালাহউদ্দিন তাকে জিজ্ঞেশ করেন, স্যার, আপনি কি আমার এবং আর্টিলারিকে শহরের দিকে যেতে বলেছেন? জবাবে শফিউল্লাহ ‘না’ বললে। সালাহউদ্দিন জানান, তারা তাে রেডিও সেন্টার, গণভবন এবং ৩২ নম্বর রােডের দিকে যাচ্ছে।

ডিএমআই ‘র কথা শুনে সেনাপ্রধান শংকিত বােধ করেন এবং জিজ্ঞেস করেন, ডাঃ সাফায়েত (৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার) নাে অ্যাবাউট ইট? কর্নেল সালাহউদ্দিন এ বিষয়ে কিছু জানেন না এবং প্রথমে আপনার কাছেই এসেছি’ জানালে শফিউল্লাহ তাকে বলেন, সাফায়েতের কাছে যাও এবং তিনটা পদাতিক ব্যাটালিয়নকে দিয়ে প্রতিহত করার জন্য আমার নির্দেশ জানাও, আমিও তাকে টেলিফোনে নির্দেশ দিচ্ছি।

শফিউল্লাহর দাবি, তিনি পরে টেলিফোনেও সাফায়াতকে একইরকম নির্দেশ দেন। সাফায়েত ও তা স্বীকার করেছেন, কিন্তু আসল কাজ কিছু হয়নি।

শফিউল্লাহ জানান, সেসময় সেনাপ্রধান বঙ্গবন্ধুকে ফোনে না পেলেও একসময় বঙ্গবন্ধুই তাকে ফোনে পেয়ে বলেন, শফিউল্লাহ তােমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বােধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।

জবাবে শফিউল্লাহ প্রেসিডেন্টকে কিছু একটা করছি বললেও রাষ্ট্রপতিকে তাৎক্ষণিকভাবে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান। আর্মি চিফ বলেছিলেন: আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং, ক্যান ইউ গেট অব দ্যা হাউস?

এর ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং সিজি এস। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ তার বাসায় আসেন। তিনি তখন খালেদ মােশাররফকে ৪৬ ব্রিগেড়ে গিয়ে সাফায়েতকে সহায়তার নির্দেশ দেন। কারণ তার ভাষায়, তখনও পর্যন্ত তার দেওয়া নির্দেশে কোনাে তৎপরতা দেখতে পাচ্ছিলেন না। জেনারেল শফিউল্লাহ জানান, এক পর্যায়ে ডেপুটি চিফ জিয়া বলেন, ডু নট সে হিম। হি ইজ গােয়িং টু স্পয়েল ইট।

সেনাপ্রধানের এভাবে কিছু করতে ব্যর্থতার মধ্যে অনুমান সকাল ৭টার দিকে রেডিও ঘােষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা শুনতে পান। এ পর্যায়ে ডেপুটি চিফ জিয়া বলেন, খালেদ মােশাররফকে আর বাইরের যেতে দিও না। তাকে বলাে ‘অপস অর্ডার’ তৈরি করতে, কারণ ইন্ডিয়ান আর্মি মাইট গেট ইন দিস প্রিটেক্সট।

শফিউল্লাহ পরে ৪৬ ব্রিগেড়ে যেতে চাইলে, তার ভাষ্যমতে, মেজর ডালিমও তার সৈন্য-সামন্ত এবং অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত গাড়ি নিয়ে তার পেছনে পেছনে যায়। মেজর রশিদ এবং মেজর হাফিজ তাকে রেডিও সেন্টারে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। সেনাপ্রধানের দাবি: ওই জায়গার পরিবেশ দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে যান এবং তাদের চাপের মুখে বলেন যে, আমি একা যাবে না, এয়ার এবং নেভাল চিফের সঙ্গে কথা বলি ।

সেনাপ্রধানের প্রতিরােধ চেষ্টা এভাবে সেখানেই শেষ হয়ে যায়। তার ভাষায় কোনাে কাউন্টার অ্যাকশনে। রক্তপাত ও সিভিল ওয়ার হতে পারে, এই ধরণের পরিস্থিতি ধারণা করে মেজর রশিদ এবং মেজর ডালিমের অস্ত্রের মুখে তিনি রেডিও সেন্টারে যেতে বাধ্য হন।

এর অনেক আগেই রেডিও সেন্টারের দখল নিয়েছিলাে ঘাতকদল। বাংলাদেশ বেতারের স্টেশন প্রকৌশলী এবং মামলার ৩৭ নম্বর সাক্ষী মােঃ রিয়াজুল হক বলেন, সেদিন সকাল ৬টা-২টা ডিউটি করার জন্য ৬টালসায়া ৬টার দিকে শাহবাগে বেতার ভবনে গিয়ে তা সেনা নিয়ন্ত্রণে দেখতে পান।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৩৮ নম্বর সাক্ষী, বেতার প্রকৌশলী প্রণব চন্দ্র রায় জানিয়েছেন, সকাল পৌণে ৬টার। দিকে কিছু সেনা সদস্য পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে বেতার ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হত্যাযজ্ঞ শেষে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তারা রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখে, মেজর ডালিম এরইমধ্যে রেডিওর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যার কথা প্রচার করছে।

শাহরিয়ার জানিয়েছে, তখন রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা তিনটি ট্রাকে করে রেডিও স্টেশনে আসলে সে তাদের ‘ডিস-আর্ম’ করে প্রথমে রেডিও স্টেশনে বসিয়ে রাখে, পরে রক্ষী বাহিনী হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যােগাযােগ করে তাদের ফেরত পাঠায়।

কিছু পরে খন্দকার মুশতাক রেডিও স্টেশনে আসে। সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইম মার্শাল একে খন্দকার, বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, পুলিশ প্রধান নুরুল ইসলাম এবং রক্ষী বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান মেজর হাসান সেখানে এসে রেডিও ঘােষণার মাধ্যমে খন্দকার। মুশতাকের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন।

রেডিও স্টেশনে সেসময় জেনারেল জিয়া ছাড়াও কর্নেল (অব.) তাহের এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল (অব.)। আতাউল গণি ওসমানী উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন ৩৭ নম্বর সাক্ষী রিয়াজুল হক।

পরে বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানেও তারা সকলেই যােগ দেন।

শফিউল্লাহ জানান; ১৫ আগস্ট শপথ অনুষ্ঠান শেষে তিনি বঙ্গভবন থেকে বাসার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তাকে বলেন, কনফারেন্স হবে, এখন যাবেন না। সেই না যাওয়া ১৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত গড়ায়। এক কাপড়ে এই ক’দিন বঙ্গভবনে অবস্থানে বাধ্য থাকার সময় তিনি ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ জিয়া, শাহ মােয়াজ্জেম এবং কে এম ওবায়দুর রহমানকে বঙ্গভবনে আসা-যাওয়া করতে। দেখেন। সবসময় তাদের সঙ্গে থাকতেী ঠাকুর।

ওইসময়ের বর্ণনা দিয়ে শফিউল্লাহ জানান, খন্দকার মুশতাক প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রথমেই গাজী গােলাম মােস্তফাকে রেডক্রস চিফের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। দ্বিতীয় যে কাজটি খন্দকার মুশতাক করেন, সেটি হচ্ছে মাহবুব আলম চাষীকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়ােগদান।

পরের সময়গুলােতে কি হয়েছে জানাতে গিয়ে শফিউল্লাহ বলেন, ১৮ আগস্ট বঙ্গভবন থেকে ফিরে রাতে একটি কনফারেন্স ডাকেন। এতে এয়ার ও নেভি চিফ, বিডিআর প্রধান, আইজি নুরুল ইসলাম, ডিজিএফআই’র ব্রিগেডিয়ার রউফ, ডি এমএ কর্নেল নূর উদ্দিন এবং ডি এসটি কর্নেল মালেকসহ সিনিয়র অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কোনাে সম্পর্ক নেই। সেনাপ্রধান হিসেবে শফিউল্লাহকে বলা হয়, এইসব উচ্ছল অফিসারের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

পরদিন ফরমেশন কমান্ডারদের যে বৈঠক ডাকা হয় তাতে খন্দকার মুশতাকের নির্দেশে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুকও যােগ দেয়। কনফারেন্সের উদ্দেশ্য ছিলাে শৃঙ্খলাভঙ্গকারী অফিসারদের সেনানিবাসে ফেরত আনা। ফেরত আনার উদ্দেশ্যে কৌশলগতভাবে শফিউল্লাহ বলেন, ইন্ডিয়া মাইট অ্যাটাক বাংলাদেশ। আমাদের এটা প্রতিহত করতে হবে। তাই রিগ্রুপিং এর দরকার আছে।

এক পর্যায়ে মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুককে লক্ষ্য করে সাফায়েত জামিল বলেন, দে মাস্ট বি পুট টু কোর্ট মার্শাল। শফিউল্লাহ বলেন, এতে তাদের মুখ মলিন হয়ে যায়।

ফারুক-রশিদের মুখ মলিন হয়ে গেলেও ব্যবস্থা কিন্তু কেউ নিতে পারেননি। বরং শফিউল্লাহর নিজের ভাষায়, মনে হলাে কনফারেন্স ডাকার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাই কনফারেন্সের সমাপ্তি ঘােষণা করে। শফিউল্লাহ চলে আসেন, প্রতিক্রিয়া দেখতে থাকেন।

অক্ষম সেনাপ্রধান আবার ২২ আগস্ট বঙ্গভবনে সেই খন্দকার মুশতাকের কাছে যান যাকে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানেন না বলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। সেদিনও তিনি টুপস ফিরিয়ে এনে রিঞপিং এর কথা জানান। জবাবে খন্দকার মুশতাক বলেন, ওয়েট এন্ড সি। এভাবে সেদিনও বঙ্গভবন থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসি,’ বলে জানান ব্যর্থ সেনাপ্রধান।।

শফিউল্লাহ জানান: ২৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে নিউজ বুলেটিনে জেনারেল ওসমানীকে ডিফেন্স অ্যাডভাইজার করার ঘােষণা জানতে পারেন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রেসিডেন্টের ফোন আসে। মুশতাক তাকে বলে, তুমি শুনেছাে? শুনেছি জানালে মুশতাক বলে, ডিড ইউ লাইক ইট? জবাবে শফিউল্লাহ বলেন, ভালাে হয়েছে। মুশতাক তাকে পরে বিকেল সাড়ে ৫টায় বঙ্গভবনে যেতে বলেন।

সময়মতো বঙ্গভবনে গিয়ে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল খলিলকে বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে যেতে দেখেন তিনি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার আগে তাকে ওসমানীর সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়।

ওসমানী শফিউল্লাহর অনেক প্রশংসা করে বলেন, তুমি দেশের জন্য অনেক কিছু করেছাে, এখন তােমার সার্ভিস। বিদেশে দরকার।

শফিউল্লাহ তখন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওসমানীসহ খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মুশতাকও শফিউল্লাহর অনেক প্রশংসা করে। বলেন, তোমার সার্ভিস এখন দেশের বাইরে দরকার।

তার জায়গায় কে আসছেন জানতে চাইলে মুশতাক জিয়ার নাম বলে। শফিউল্লাহ তখন বলেন, ডােন্ট থিংক এট দিস স্টেজ জিয়া উইল বি মিসআল্ডারস্ফুড? জবাবে মুশতাক বলে, দিস উইল বি টেকেন কেয়ার অফ।

শফিউল্লাহ দেশের বাইরে যেতে রাজি নন জানালে মুশতাক বলেন, ডােন্ট থিংক অব স্টেয়িং ইন দ্যা কান্ট্রি। শফিউল্লাহ তখন আর উচ্চবাচ্য না করে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসেন বলে জানান। দেখেন জেনারেল জিয়া এরইমধ্যে চিফ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে অফিসারদের সঙ্গে মিটিং করছেন।

জেনারেল শফিউল্লাহ সেদিন সেনাপ্রধানের পদ হারানাের আগে জিয়াসহ যাকে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেন, সেই জেনারেল খলিল ৪৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জানান: ২০ আগস্ট খন্দকার মুশতাক মার্শাল । জারি করে। ২৪ আগস্ট জানতে পারেন জেনারেল ওসমানীকে ডিফেন্স অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়ােগ। দেওয়া হয়েছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বঙ্গভবন থেকে তাকে বিকেল ৪টায় বঙ্গভবনে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে দেখেন, জেনারেল জিয়াও উপস্থিত।

মেজর রশিদ, মেজর ডালিম এবং আরাে একজনের উপস্থিতিতে জেনারেল ওসমানী জেনারেল খলিলকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ এবং জেনারেল জিয়াকে চিফ অব আর্মি হিসেবে ঘােষণা দেন। একইসঙ্গে ওইসময় ভারতে অবস্থান করা ব্রিগেডিয়ার এরশাদকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে ডেপুটি চিফ অব। আর্মি স্টাফ এবং জেনারেল দস্তগীরকে বিডিআর চিফ করা হয়। অপরদিকে, শফিউল্লাহকে বদলি করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

এভাবে মুশতাকের ডিফেন্স অ্যাডভাইজার হওয়া মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির তত্ত্বাবধানে পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলােতে বসানাে শুরু হয়।

আর ১৮ আগস্ট বিমানবাহিনী প্রধান হিসেবে পদত্যাগ করা মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি এ কে খন্দকারের জায়গায় তখন জার্মানিতে অবস্থান করা গ্রুপ ক্যাপ্টেন তােয়াবকে বিমানবাহিনী প্রধান করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে সব ধরণের বেনিফিটসহ অবসরে যাওয়া তােয়াৰ ৭১ থেকে জার্মানিতেই অবস্থান করছিলেন। তাকে সেখান থেকে দেশে নিয়ে আসে মুশতাকের দুই বিশেষ সহকারির একজন মেজর রশিদ। অন্য বিশেষ সহকারি ছিলাে, মেজর ফারুক।

তােয়াব দায়িত্ব নেওয়ার পর খন্দকারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওএসডি করা হয়। পরে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ফলে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন বিচারপতি সায়েম তাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়ােগের প্রস্তাব দিলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে তিনি তাতে রাজি হন বলে জানান। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে আস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার করা হয়।

তখন ওসমানীর প্রভাব কমে আসলেও আগের অনেক ঘটনার নেপথ্যেই ছিলেন ৭৫’র ১৫ আগস্ট সকালে রেডিও স্টেশন থেকে মুশতাকের পাশে পাশে থাকা জেনারেল ওসমানী। ২৪ আগস্ট তিনি প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হলেও আরাে প্রায় ১০ দিন আগে থেকেই তিনি সশস্ত্রবাহিনীকে খুনিদের পক্ষে পরিচালনা করেন।

তবে তার নিয়ন্ত্রণও খন্দকার মুশতাকের মতােই খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

১৫ আগস্ট এবং জেলহত্যার খুনিরা দেশ ছাড়ার পরের পরিস্থিতি বর্ণনা করে ততােদিনে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ হওয়া জেনারেল খলিল বলেন, ৩ নভেম্বর খুব সকালে ডিজিএফআই’র এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলাম তাকে ফোন করে জানান, ক্যান্টনমেন্টে ট্রপস মুভমেন্ট হচ্ছে এবং বেশ গােলমাল। তাকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিয়ে তিনি ওসমানীকে টেলিফোন করেন। কিন্তু তাকে ফোনে পান না। পরে যখন ওসমানীকে পান, তখন আরাে একবার তিনি (ওসমানী) খন্দকার মুশতাকের পক্ষে তার অবস্থান তুলে

সকাল ১০টার দিকে খলিল বঙ্গভবনে গেলে সেখানে আইজিপি নুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানান, কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তারা প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি মাহবুব। আলম চাষীর সঙ্গে দেখা করলে চাষী প্রেসিডেন্টের রুম থেকে ফিরে জানান, রাষ্ট্রপতি সব ঘটনাই জানেন।

সন্ধ্যার দিকে জেনারেল খলিল শুনতে পান, মেজর রশিদ গং দেশ ছেড়ে চলে গেছে। পরদিন বিকেলে বঙ্গভবনে কেবিনেট মিটিংয়ে জেলহত্যা বিষয়ে জানার জন্য তিন বাহিনী প্রধানকে ডাকা হয়। মিলিটারি সেক্রেটারির রুমে অপেক্ষা করার সময় তিনি কেবিনেট মিটিংয়ে খুব গােলমালের শব্দ শুনতে পান।

তখন দৌড়ে কেবিনেট রুমে গিয়ে খলিল দেখেন, কর্নেল সাফায়েত জামিল কয়েকজন আর্মি অফিসারসহ সশস্ত্র অবস্থায় কেবিনেট রুমে ঢুকে পড়েছেন। জেনারেল ওসমানী তাদেরকে গুলি না করার জন্য অনুরােধ করতে থাকেন। সশস্ত্র অফিসারদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন ওসমানী।

পরে সাফায়েত জামিল খন্দকার মুশতাককে জেলহত্যা তদন্তে ইনকোয়ারি কমিশন গঠন এবং পদত্যাগে বাধ্য করতে পারলেও জেনারেল ওসমানীর বদৌলতেই সেদিন খন্দকার মুশতাক বেঁচে যান।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে, মুশতাককে ১৫ আগস্ট সকাল থেকেই পথমে পদপদবী ছাড়া এবং পরে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে সমর্থন করে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী।

তবে পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে তিনি আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী হয়েছিলেন। আর। জিয়া নিহত হলে আওয়ামী লীগের মনােনয়ন না পেলেও বিচারপতি সাত্তারের বিরুদ্ধে অন্য দল থেকে প্রার্থী হন জেনারেল ওসমানী।

কুমিল্লার বার্ড থেকে ঢাকার আগামসি লেন

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে দেশী বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রকে এক-করে জালটি বিছানাে হয়েছে কুমিল্লার বার্ড থেকে। সেখানে ষড়যন্ত্রকারীরা একাধিক বৈঠক করেছে। ঢাকার আগামসি লেন হয়ে সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দুটি ইউনিটের সেনা কর্মকর্তারা। কয়েকমাস ধরে কয়েকজন রাজনীতিক এবং সেনা কর্মকর্তা কুমিল্লা এবং খন্দকার মুশতাকের আগামসি লেনের বাড়িতে বসে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে যাওয়ার কাজ করে গেলেও ডিজিএফআই একবার শুধু রাষ্ট্রপতিকে কয়েক সেনা কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রের আভাস দিয়েছিলাে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, চাকুরিচ্যুত এবং চাকুরিরত ওই সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী বা অন্য কোনাে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনাে ব্যবস্থা নেয়নি।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারে কুমিল্লা ষড়যন্ত্র বিষয়ে ৪৩ নম্বর সাক্ষী হিসেবে আলােকপাত করেছেন কুমিল্লা। ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক অধ্যাপক খুরশিদ আলম।

প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি জানান, শিক্ষাজীবনেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কুমিল্লার বুড়িচং এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের মনােনয়নে এম, এন, এ নির্বাচিত হন।

কুমিল্লা বার্ডের ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় দিতে গিয়ে শীর্ষে তিনি। খন্দকার মুশতাকের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় মুশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার চেষ্টা চালিয়েছিলাে। তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন থেকেই খন্দকার। মুশতাকের সচিব হিসেবে কাজ করছিলাে আরেক ষড়যন্ত্রকারী মাহবুবুল আলম চাষী।

পরে খন্দকার মুশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান অধ্যাপক খুরশিদ আলম।।

জাতির জনক হত্যার মূল ষড়যন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, বন্যায় অনেক খাদ্য শস্য বিনষ্ট হয়। তখন কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) বন্যা। উত্তর কর্মসূচি নেয়। ওই বার্ডের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলাে মাহবুবুল আলম চাষী। খন্দকার মুশতাকই তাকে এই পদে নিয়ােগের ব্যবস্থা করেছিলাে।

সেই বন্যা উত্তর কর্মসূচি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলাে। কর্মসূচিটি পরে স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি হিসেবে চালু হয়। বৈঠকগুলাে হতাে বার্ডে।

ওই বৈঠকগুলােকে কিভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের উপলক্ষ করা হতাে সেটা অবশ্য তখন তিনি বুঝতে পারেননি, যখন বুঝতে পারেন তখন ইতিহাসের নৃসংশতম হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে।

অধ্যাপক খুরশিদ আলম জানান, ১৯৭৫ সালের মার্চের শেষদিকে খন্দকার মুশতাক ও মাহবুব আলম চাষীর উদ্যোগে বার্ডে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মেলন হয়। তিনদিন ধরে সেই সম্মেলন চলে।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিকেলে বার্ডের রেস্টহাউসে বসে তিনি তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং দু’জন এমপিসহ চা পান করছিলেন। এমন সময় একটি আর্মি জিপে সিভিল ড্রেসে খন্দকার মুশতাকের আত্মীয় মেজর। খন্দকার আব্দুর রশিদ এবং আরাে একজন সেনা কর্মকর্তা আসে। অন্যদের সেখানে রেখে দু’ সেনা কর্মকর্তা এবং মাহবুবুল আলম চাষীসহ তাহেরউদ্দিন ঠাকুর রেস্টহাউসে খন্দকার মুশতাকের কক্ষে যায়। ত্রিশ থেকে ৪০ মিনিট ধরে মুশতাকের কক্ষে রাজনীতিক মুশতাক ও ঠাকুর, আমলা চাষী এবং সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক চলে।

মাগরিবের আগে সেনা কর্মকর্তারা চলে যায় বলে অধ্যাপক খুরশিদ আলম জানান।

এভাবে রাজনীতিক-আমলা-সেনা চক্রের মধ্যে আরাে বৈঠকের কথা জানিয়ে খুরশিদ আলম জানান, ৭৫’র মে-জুনে খন্দকার মুশতাকের গ্রামে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় মুশতাকের আমন্ত্রণে শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী, চিফ হুইপ শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, আলী আশরাফ এমপি এবং তিনি উপস্থিত ছিলেন।

খেলাশেষে তারা মুশতাকের বাড়িতে চা-চক্রে যােগ দেন। চা-পানের সময় বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নীতি এবং কর্মসূচির সমালােচনা করতে থাকে খন্দকার মুশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং শাহ মােয়াজ্জেম। সেই সমালােচনায় শাহ মােয়াজ্জেমকে অত্যন্ত উৎসাহী এবং সােচ্চার দেখা যায়, বলে জানান খুরশিদ আলম।

এছাড়াও বিভিন্ন সময় খন্দকার মুশতাককে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পলিসির ব্যাপারে বিদ্বেষমূলকভাবে কটাক্ষ করতে দেখা যায় বলে এই সাক্ষী জানিয়েছেন।

পাশাপাশি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মুশতাকের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বৈঠক চলতে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন: ৭৫’র জুন-জুলাই মাসে দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সম্মেলন হয়। সেই সম্মেলনে খন্দকার মুশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি (খুরশিদ আলম)উপস্থিত ছিলেন। আলী আশরাফ এমপিও ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, পরে মাহবুব আলম চাষী যােগ দেয়।

“সেই সম্মেলন চলাকালে আর্মির জিপে মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার এবং আরাে কয়েকজন সামরিক অফিসার আসে। সম্মেলন শেষে তিনি (খুরশিদ আলম) কুমিল্লা চলে গেলেও চাষী, রশিদ, ফারুক এবং শাহরিয়ার খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে মুশতাকের বাড়িতে যায়।’

তিনি জানান, যে সামরিক কর্মকর্তারা মুশতাক-ঠাকুর-চাষীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে, তাদেরকেই পরে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি হিসেবে তিনি দেখতে পান।

বঙ্গবন্ধু সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতেও একইরকম বক্তব্য এসেছে।

তার স্বীকারােক্তির শুরুটা এরকম: ১৯৭৪ সালের বন্যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে কৃত্রিম খাদ্য সংকটের কারণে অবস্থা আরাে সংকটাপন্ন হলে সদ্য স্বাধীন দেশটির সামগ্রিক পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে পড়ে। এ সুযােগে কিছু রাজনীদিবিদ এবং সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য একযােগে একটি পরিকল্পনা। আঁটে। ১৯৭৫ সালে শাসনতন্ত্র সংশােধন করে বাকশাল গঠন, গভর্নর পদ্ধতি চালু এবং অন্যান্য কারণে কিছু চাকুরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তার মধ্যে হতাশা বিরাজ করছিলাে।

এরপর তার স্বীকারেক্তিতেও বার্ডের সেই সম্মেলনে মেজর রশিদের সঙ্গে, পরিবার পরিকল্পনা সম্মেলনে মেজর রশিদ, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার ও মেজর ফারুকের সঙ্গে এবং ফুটবল ম্যাচের পর সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুশতাকের বৈঠকের কথা এসেছে।

এর বাইরে ঠাকুরের জবানবন্দিতে আছে: ৭৫’র মে বা জুন মাসে ঢাকার গাজীপুরের সালনায় শাপলা হাইস্কুলে ঢাকা বিভাগীয় স্বনির্ভর সম্মেলন হয়। সেখানেও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত হয়। তাদের মধ্যে মেজর নূর, মেজর শাহরিয়ার এবং মেজর ফারুক ছিলাে। সেখানে মুশতাক সেনা অফিসারদের। জিজ্ঞেস করে, তােমাদের আন্দোলনের কি অবস্থা? জবাবে তারা বলে, বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা। তার প্রতিনিধি।।

ঠাকুর একথাও জানিয়েছে, আইয়ুব আমলের দুই জেনারেল এম আই করিম এবং চৌধুরীর সঙ্গে মুশতাকে। ঘনিষ্ঠতা ছিলাে। তারা বেশ কয়েকবার গুলশানের বাসায় আসা-যাওয়া করেছেন। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় এই দুজনের নাম আর তেমনভাবে কোথাও আসেনি।

মুশতাকের বিষয়ে ঠাকুর এছাড়াও জানিয়েছে, ৭৫’র আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গভর্নর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খন্দকার মুশতাক উপস্থিত ছিলাে। ঢাকা ফেরার পথে মুশতাক হাসতে হাসতে গভর্নর আলী আলমকে বলে, গভর্নর তাে হয়েছেন, কাজ শুরু করতে পারবেন তো?

তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের জবানবন্দিতে এরপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাতের কথা বলা হয়েছে। বর্ণনাটা এরকম: ১৩ আগস্ট অনুমান বিকেল ৩টায় শেখ মুজিবুর রহমানের তলবমতে গণভবনে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাকে পেছনে ডেকে নিয়ে বলেন, তাের ওপর খুব অবিচার হয়েছে। এটা ঠিক হচ্ছে না।

খন্দকার মুশতাককে একথা জানানাের পর মুশতাক বলে, তা হলেতাে ভালােই। তােমার পদোন্নতি হচ্ছে। অপেক্ষা করাে, কখন কী হয়। মুশতাক অবশ্য সেসময় কোনােকিছুর ইঙ্গিত দিয়ে তাকে আপাততঃ ঢাকার বাইরে যেতে নিষেধ করে, পরদিন তার অফিসে দেখা করতে বলে।

জবানবন্দি অনুযায়ী, পরদিন মুশতাকের সঙ্গে দেখা হলে ঠাকুরকে মুশতাক বলে, এ সপ্তাহে জিয়া দুইবার এসেছিলাে। সে এবং তার লােকেরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। ঠাকুরের প্রশ্নের উত্তরে মুশতাক জানায়, জোরপূর্বক ক্ষমতা বদলাতে চায়। প্রয়ােজনবােধে যে কোনাে কাজ করতে প্রস্তুত।

ঠাকুরের আরাে প্রশ্নে মুশতাক তার মতামত দিয়েছে বলে ঠাকুরের স্বীকারােক্তিতে আছে। কারণ হিসেবে মুশতাক তাকে বলেছিলাে, এছাড়া অন্য কোনাে উপায় নেই। মুশতাক সেসময় ঠাকুরকে তার সঙ্গে থাকতে এবং ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে পরামর্শ দেয় বলে জানিয়েছে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। পরদিন মেজর ডালিমের ঘােষণায় ঠাকুর বুঝতে পারে, এতােদিন যে অফিসাররা খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে যােগাযােগ রাখছিলাে তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে।

মুশতাকের সঙ্গে যে খুনি সেনা কর্মকর্তাদের বেশ আগে থেকেই যােগাযােগ ছিলাে সেটা মেজর ফারুকের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতেও পাওয়া যায়।

তার জবানবন্দিটা এরকম: মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ পরিকল্পনা মােতাবেক পলিটিক্যাল যােগাযােগ। হিসেবে তার আত্মীয় তত্ত্বালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চলে। খন্দকার। মুশতাকের সঙ্গে মেজর রশিদ ও ডালিম আলােচনা করে যে, বাকশালের পতন ঘটাতে হবে এবং প্রয়ােজনে শেখ মুজিবকে হত্যা করতে হবে; নইলে দেশ বাঁচবে না। মেজর ফারুকও এ ধারণা,

ফারুক স্বীকার করেছে, খন্দকার রশিদ জানায় যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারলে জিয়াও তাদেরকে সমর্থন দেবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে রশিদের সঙ্গে মুশতাকের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিলাে ১৪ আগস্ট।

স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে খন্দকার মুশতাক এবং মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদের মধ্যে ১৪ আগস্টের বৈঠকের বর্ণনা দিয়েছে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত খুনিদের একজন মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান। সেনাবাহিনী থেকে আগেই অবসরে যাওয়া শাহরিয়ার ওইদিন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছিলাে। বিকেলে রশিদ এবং মেজর নূর তাকে মন্ত্রী খন্দকার মুশতাকের আগামসি লেনের বাসায় নিয়ে যায়। যাবার পথে তারা গাড়ি রেখে যায় চানখারপুলে। সেখানে তাদের মধ্যে এমন আলােচনা হয় যাতে পরদিন সকালে তার বাসায়ই অবস্থান করে খন্দকার মুশতাক।

জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য চিরস্থায়ী কলঙ্ক

রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের জীবন রক্ষায় সামরিক এবং গােয়েন্দা ব্যর্থতাকে সেনাবাহিনীর জন্য চিরস্থায়ী কলংক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারক কাজী গােলাম রসুল। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য এটি একটি চিরস্থায়ী কলংক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, বলে রায়ে মন্তব্য করেন ঢাকা জেলা এবং দায়রা জজ আদালত। নাজিমউদ্দিন রােডে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে বিশেষ এজলাসে এক বছরের মতাে সময় ধরে চলে ওই বিচার। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর রায় ঘােষণা করেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গােলাম রসুল। রায়টি এখন ঐতিহাসিক এক দলিল।

যেহেতু বিশাল রায়, বিচারক তাই এজলাসে পুরাে রায় না পড়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড আর চারজনকে বেকসুর খালাস দেয়ার মূল আদেশটি পড়ে শুনিয়েছিলেন। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণও পাঠ করেছিলেন বিচারক।

সেই পর্যবেক্ষণে তিনি সুস্পষ্টভাবে সেনা কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা এবং রহস্যজনক আচরণের সমালােচনা করেছেন।

ডেথ রেফারেন্সের পেপার বুকের দলিল ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, রায়ের একেবারে শেষদিকে এসে ১৫ আগস্টের। হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বিচারক কাজী গোলাম রসুল লিখেছেন (সাধু থেকে চলিত ভাষায়): প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ । না করে করে পারা যায় না যে, এই মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিশেষ করে যারা ঢাকায় অবস্থান করছিলেন, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি, এমনকি পালনের কোনাে পদক্ষেপও গ্রহণ করেননি।

সঙ্গে বিচারক একথাও বলেছেন ‘যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও, তারা দায়িত্ব পালন করেননি।

বিচারক লিখেছেন: অত্যন্ত দু:খের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন আদেশ পাওয়ার পরও তার নিরাপত্তার জন্য কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সাক্ষ্য প্রমাণে পরিষ্কার যে, মাত্র দুটি রেজিমেন্টের খুবই অল্প সংখ্যক জুনিয়র সেনা অফিসার/সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলাে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেনাে এই কিছু সেনা সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ/নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেনি তা বােধগম্য নয়।

“এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলংক হিসেকে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, বলে তিনি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

খুনি কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা হলেও, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষীদের সাক্ষ্যের লাইনে লাইনে ফুটে। উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক সেই ব্যর্থতার কথা।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মূল অভিযুক্ত ছিলাে ২৪ জন। তাদের মধ্যে খন্দকার মুশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, ক্যাপ্টেন মােস্তফা এবং রিসালদার সারােয়ার ৯৬ সালে মামলার কার্যক্রম শুরু হওয়ার। আগেই মারা যাওয়ায় তাদেরকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভূক্ত করা

অন্য যে ২০ জনকে অভিযুক্ত করা হয় তাদের মধ্যে মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা রশিদ উচ্চ আদালতে রিভিশন মামলায় অভিযােগের দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় বিচার হয় ১৯ জনের বিরুদ্ধে।

তাদের মধ্যে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, অনারারি ক্যাপ্টেন আব্দুল। ওয়াহাব জোয়ার্দার, দফাদার মারফত আলী এবং এল, ডি আবুল হাশেম মৃধাকে খালাস দেন বিচারিক আদালত।

কাঠগড়ায় থাকা মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার এবং আর্টিলারির কর্নেল মুহিউদ্দিনসহ ১৫ জনকে দেওয়া হয়ে মৃত্যুদণ্ড। এই তিনজনসহ পলাতক ১২ জনের মধ্যে ল্যান্সারের মেজর মহিউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদাকে দেশে ফিরিয়ে এনে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এদের মধ্যে বজলুল হুদাকে রায় ঘােষণার দিনই ব্যাংকক থেকে আনা হয়। মেজর মহিউদ্দিনকে ফেরত আনা হয় ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক আমলে।

এর বাইরে বিচারিক আদালতের মতাে উচ্চ আদালতেও মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, মেজর রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মাজেদ এবং রিসালদার মােসলেহউদ্দিন বিদেশে পালিয়ে আছে। পলাতক অবস্থায় মারা গেছে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মেজর আজিজ পাশা। আর বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পেলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছে মেজর আহম্মেদ শরফুল হােসেন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম এবং ক্যাটেল নাজমুল হােসেন আনসার।

অর্থাৎ, চূড়ান্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১২ জনের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও এখনও পালিয়ে আছে ছয়জন।

অপরাধের ধরণে হাইকোর্টের অনুমােদন সাপেক্ষে ১৫ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যেকরের আদেশ দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। তবে রায়ে একথাও বলা হয়েছিলাে, নির্দেশ অনুযায়ী ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে কর্তৃপক্ষের কোনাে অসুবিধা থাকলে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হলাে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে সেদিন আদালত একথাও বলেছিলেন, ঘটনার পর কোনাে কোনাে আসামী দেশে-বিদেশে আত্মস্বীকৃত খুনি হিসেবে পরিচয় দিয়ে দাম্ভিকতা প্রকাশ করে। ঘটনাটি কেবল নৃশংসই নয়, এই ঘটনায় দু’জন সদ্যবিবাহিতা বধূকে ও ১০ বছরের একজন শিশুকেও নির্মমভাবে গুলিতে হত্যা করা হয়।

আসামীদের এই অপরাধ এমন একটি ক্ষতির কাজ যা শুধু ব্যক্তিবিশেষের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষেও মারাত্মক ক্ষতি। দেখা যায় যে, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতির বিষয় সজ্ঞানে জ্ঞাত থেকে ষড়যন্ত্রটি পরিকল্পিতভাবে ঘটানাে হয়েছে। সুতরাং তাদের প্রতি কোনাে প্রকার সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শনের সুযােগ নেই,’ চূড়ান্ত শাস্তি ঘােষণার আগে এভাবেই তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আদালত।

জাতির জনক হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে এবং পরে খুনিদের বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সুবিধাবাদের দিকটিও রায়ে তুলে ধরেছিলেন বিচারপতি কাজী গােলাম রসুল। ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: সকল সাক্ষ্য প্রমাণ পর্যালােচনায় ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখ বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে আসামি তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের জড়িত থাকা সম্পর্কে স্পষ্ট প্রমাণ বা সম্মতি নেই। কিন্তু ঘটনার পরপরই রেডিও স্টেশনে যাওয়াসহ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

*এখন প্রশ্ন হলাে, এই বিজড়নের কারণে তাকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলা যায় কি না? এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা এই যে, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে ও পরে নেতার অনুসারীগণের ব্যবহারে অনেক পার্থক্য। এটা কিছুটা বােধগম্য, আমাদের দেশের নেতাভিত্তিক রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে যেমন- নেতা আছেন তাে সব আছে, আমিও আছি, নেতা নাই তাে কেউ নাই, আমিও নাই, উল্লেখ করে বিচারক বলেন, ঠাকুরের মতাে বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠজনেরাও পরে মুশতাক মন্ত্রিসভায় যােগদান করেন।

তবে ইতিহাস সাক্ষী শেষ পর্যন্ত জাতির জনক হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু মামলা দায়ের করে বিচার শুর করতেই লেগে গিয়েছিলাে দুই যুগ। এর কারণ খুনিদের দায়মুক্তি দেওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ।

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলে ওই বছরের নভেম্বর মাসে কুখ্যাত অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। এর কয়েকদিন আগে ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেন। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচার শুরু হয় ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ।

দেড়শ’ কার্যদিবস শুনানির পর ১৯৯৮ সালে ৮ নভেম্বর ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গােলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এরপর হাইকোর্টে একের পর এক ঘটে বিব্রত হওয়ার ঘটনা। একাধিক বিচারপতি। ডেথ রেফারেন্সের আপিল শুনানিতে বিব্রতবােধ করলে ২০০০ সালের জুন মাসে বিচারপতি মাে, রস্থল। আমিন ও বিচারপতি মাে, এবি এম খায়রুল হকের বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। মােট ৬৩ কার্যিদিবস শুনানির পর ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর এ মামলায় বিভক্ত রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখলেও ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন বিচারপতি মাে. রহুল আমিন ।

এরপর ২০০১ সালে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয় তৃতীয় বিচারপতি মাে. ফজলুল করিমের আদালতে। তিনি ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামির মধ্যে কারাবন্দি চারজন লিভ টু আপিল দায়ের করে। কিন্তু এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হলে বিএনপি-জামায়াত আমলে নানা অজুহাতে শুনানি আর হয়নি। পরে ল্যান্সার মহিউদ্দিনকে ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আনা হলে তার পক্ষেও “লিভ টু আপিল’ হয়। অর্ধযুগ পর ২০০৭ সালে শুরু হয় শুনানি। ২৫ কার্যদিবস শুনানির পর আসামিদের চূড়ান্ত আপিল শুনানি শুরুর অনুমতি দেন সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু প্রয়ােজনীয় সংখ্যক বিচারপতির অভাবে। শুনানি শুরু হতে আবারও সময় লাগে, পেরিয়ে যায় আরাে অনেক মাস।

তবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে জট খুলতে শুরু করে। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি মাে. জিল্লুর রহমান আপিল বিভাগে ৪ জন বিচারপতিকে নিয়ে দেন। এরপর ৫ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগে নানি শুরু হয়ে চলে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। এক সপ্তাহের মাথায় ১৯ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত আসামিদের আপিল খারিজ করে দিলে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।

এরপর আসামিরা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানায়। প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ ওই ‘রিভিউ পিটিশনও খারিজ করে দেন। একাধিক আসামি এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করলে তাও নাকচ হয়।

অবশেষে জাতির জনক হত্যার ৩৪ বছর পর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি কার্যকর হয় ফারুক, শাহরিয়ার, বজলুল হুদা, ল্যান্সারের মহিউদ্দিন এবং আর্টিলারির মুহিউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!