You dont have javascript enabled! Please enable it!

সানডে টেলিগ্রাফ, ১৬ এপ্রিল,১৯৭১
হত্যা বয়ে চলছে যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানিরা জীবনের জন্য যুদ্ধ করছে।
ডেভিড লোশাক, সিলেট, পূর্ব পাকিস্তান

পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন জেলায় মূল শহরের নিয়ন্ত্রনের জন্য অসভ্য যুদ্ধ চলছে। গতকাল কেন্দ্রীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেও “বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর” কাছ থেকে নিয়ন্ত্রন গ্রহন করতে পারেনি।

পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দৃঢ় প্রতিজ্ঞভাবে চেষ্টা করছে আগামি দুই সপ্তাহ অর্থাৎ বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করতে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ চলছে। এবং উভয় পক্ষই গুরুতর রকমের ক্ষতির শিকার হয়েছে।

গত রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একাত্মতা প্রকাশ দেখে মনে হয়েছিল তারা উপরের দিকে রয়েছে কিন্তু আমি ক্রমাগত দুই দিন ধরে কামান দাগান দেখার ফলে এটা পরিষ্কার যে যুদ্ধ শেষ হতে অনেক দেরি আছে।

“মুক্তি ফৌজের” অপ্রশিক্ষিত এবং নাম মাত্র সংগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের “স্বাধীনতা বাহিনী” তারা তাদের শেষ ইচ্ছা শক্তি দ্বারা শহর রক্ষায় যুদ্ধ করে যাবে। এখন তা একটি ধংসপ্রাপ্ত শেল। তারা প্রায় ১০০ পাঞ্জাবিকে মেরেছে যা ছিল ৮০০ এককের সম্পূরক।

তাদের নিজেদের ক্ষতি আরও মারাত্মক কিন্তু হাজার হাজার বাঙ্গালী যুদ্ধ করতে তৈরি এবং তারা ধারাবাহিকভাবে তাদেরকে মৃতদের জায়গায় প্রতিস্থাপিত করছে। আমি তাদের এই চরম অবস্থায় সন্দেহাতীত ভাবে দৃঢ় মনোবল দেখেছি। তারা যুদ্ধ করে মরার জন্য তৈরি।

গ্রামাঞ্ছলে নিয়ন্ত্রন
এখন মুক্তি ফৌজ প্রায় সম্পূর্ণ গ্রামাঞ্চল নিয়ন্ত্রন করছে। খাদিমনগর সেনানিবাস যা শহরের পূর্বে অবস্থিত তা নিয়ন্ত্রনে আনার পর সালুতিগার বিমানবন্দর যা সিলেটের পাঁচ মাইল উত্তরে অবস্থিত তারা সেখানের সেনাবাহিনীকে অবরুদ্ধ করেছে।

বিজয় আনতে হলে মুক্তি ফৌজের জরুরিভাবে অস্ত্র এবং গোলাবারুদের সরবারহের প্রয়োজন।
প্রায় চার দিন পাহাড়, ভারতের আসামের জঙ্গল এবং সিলেটের উত্তর প্রদেশ এবং তারপর নিম্ন সমভূমি, চা বাগান এবং ধান ক্ষেতের মাঝে দিয়ে যাত্রার পর আমি গতকাল খাদিমনগর পৌঁছেছি।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাবী যে ভারতের সীমান্ত বন্ধ এবং সীমানা পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ তা সত্ত্বেও দৃষ্টি আচ্ছন্নকারী পরিপূর্ণ বৃষ্টির মাঝে আমি সিলেটের উত্তর-পশ্চিম থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরের সীমান্ত পার হয়েছি।

রুট বন এবং লতা গুল্মের জঙ্গলের মাঝে দিয়ে গ্রামাঞ্ছলের পথ ঘুরে প্রবেশ করেছি যা কাঁঠাল পাকা ভারি গাছ এবং গ্রীষ্ম প্রধান সবুজ আগাছায় বেষ্টিত।

তারপর হুমড়ি খেতে খেতে শুকিয়ে যাওয়া নদী গর্ভের পথের সাথে সাথে দীর্ঘ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পাহারের পাদদেশে যা বর্ষার বিশাল জলপ্রপাতে স্ফীত এবং সবশেষে প্রসারিত এবং কর্কশ নলখাগড়ার মাঝে দিয়ে আমি এসেছিলাম প্রায় একটি পরিস্কার জঙ্গলের বসতিহীন বন্দোবস্তে। সেখানে আমি প্রথমে সেই অঞ্চলের মুক্তি ফৌজের সাথে যোগাযোগ করি। বাংলাদেশের পশ্চিম দিক যা ভারতের পশ্চিম বাংলার সীমান্ত বরাবর অবস্থিত সহযোগীদের থেকে অসম্পূর্ণ অসদৃশ এই মানুষগুলো ইতিমধ্যে যুদ্ধ কঠিনীভূত ছিল।

সম্মুখে বিপদ
বাংলাদেশের কেউই তার আসল নাম দেয়নি এবং আমি প্রতিহিংসা এড়াতে আমি সব জায়গার নামই রিপোর্ট করছি না। স্থানীয় কমান্ডার যিনি নিজেকে ক্যাপ্টেন দুদু মিয়া উল্লেখ করেন। তিনি বলেন এখনের চেয়ে আগের দিনগুলো আরও বিপদজনক ছিল।

আমি আসামে আগে যা দেখেছি তিনি তা নিশ্চিত করেন। সেখানে নিচের দিকের সমভূমিতে আমি বিস্তৃত ভুদৃশ্য জুড়ে আগুন জলতে দেখেছি। সেখানে মেঘের নিচে ধোঁয়ার স্তর ছিল।

ক্যাপ্টেন মিয়া বলেন , সিলেটে ভারী যুদ্ধ চলছে। অঞ্চলটি ধারাবাহিক ভাবে ৩ ইঞ্ছি মর্টার এবং ৬ ইঞ্ছি কামান হামলার অধীনে রয়েছে। সেইসাথে চীনা এম আই জি এস এবং পশ্চিম পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর আমেরিকান সৈন্য বলের জেট হামলাও রয়েছে।

উপরোক্ত ছালুতিগুর বিমানবন্দর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা পুনরাবৃত্তিকভাবে আক্রমন চালিয়ে গ্রাম এবং চা বাগান জ্বালিয়ে দিচ্ছিল।

অন্ধকারে ভ্রমন আত্মঘাতী হবে তাই আমি গ্রামের আদর্শস্বরূপ “পুঞ্জি” যা গ্রামের সাধারণ খড়ের ঘরে বসবাসকারীদের বাঁশের তৈরি “চঙ্গ” এর প্লাটফর্মে ঘুমাই।

রাতটি ছিল মৃতের মত নীরব ছিল আর যা বিশৃঙ্খল স্থানীয় কুকুরের ঘেউ ঘেউ অথবা ইস্পাতের মত শক্ত মশার আঘাতে নীরবতা ভাঙ্গছিল ।

সকালে আমি সশস্ত্র সহচরের সঙ্গে সিলেটে যাত্রা করেছিলাম। বাংলাদেশ বাহিনীর সাথে অতি কৃশ যোগাযোগ হয় এবং আমাদের দেখা হতে পারে কিনা তা জানার কোন উপায় ছিল না।

বাঁশের খুটি দ্বারা ঘেরা গ্রামের পর আমার জীপ পুরু কাঠের ঘেরা ব্রিটিশ মালিকাধীন চা এস্টেটের মাঝে দিয়ে পার হয়। তা মূলত মানবহীন, ঘন সবুজ ঝোপ যা পরিচর্যাহীন এবং অ-বাছাইকৃত ছিল।

বাগানের শ্রমিকেরা তাদের ঘর থেকে ভীত, বুদ্ধিভ্রষ্ট ও উদাসভাবে তাকিয়ে ছিল।

ভারী লোকসান সত্ত্বেও “স্বাধীনতা যোদ্ধাদের” উদ্দিপনা অনেক ছিল। কৃষকদের মনোবল প্রায় ভাটার মত মনে হচ্ছিল।

তাদের অবস্তা ভয়াবহ। এক পাউনড চাল ছাড়া তাদের কাছে আর কোন খাবার ছিল না। বর্তমান অবস্থায় তারা খুব বেশি ধান চাষ করতে পারে নি। মজুদ দুই সপ্তাহের বেশি চলবে না। সেনাবাহিনী বেশিরভাগ গুদামঘর হয় লুটপাট করেছে আর না হয় জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন লবন, কেরোসিন তেল কেনার মত অর্থও তাদের কাছে নেই। এমনকি এই সব সীমানা পার হয়ে আনা যেতে পারে যা খুবই কঠিন।

ছোট গুটি বসন্ত এবং কলেরা
অসুস্থতা মহামারী আকারে ধারন করেছে। একজন গ্রাম্য ডাক্তার আমাকে বলেন সেখানে নিশ্চিত ১০জন গুটি বসন্তের এবং ৪জন কলেরার রুগী রয়েছে। স্ক্রামের সরবরাহ ফুরিয়ে গেছে।

আমাকে জীপ দিয়ে সিলেটে নামানো হয়েছে। তাদের উদ্দিপনা সত্ত্বেও মুক্তি ফৌজের লোকেরা সামরিকভাবে সরল। এমনকি তারা সবচেয়ে প্রাথমিক আত্মরক্ষামূলক প্রতিরক্ষাও সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখেনি। খোলা রাস্তা বরাবর আকস্মিক আক্রমনের এবং তারা তাক করার জন্যও প্রস্তুত ছিল না।

তারা দুঃখদায়ক ররকমের সজ্জিত। তাদের কাছে খুবই সেকেলে একটি ভাণ্ডার আছে। যেখানে ছোট অস্ত্র এবং সম্ভবত একটি বা দুটি লুণ্ঠিত মর্টার আছে। অন্যথায় বর্শা, তীর ধনুক এবং স্থানীয় দা, ছুড়ি যা গুরখা “কুকারট” এর মত; এগুলো ছাড়া ভরসা করার মত কিছুই নেই।

অন্যান্য বেসামরিক জনগণের মত তাদের খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে এবং এর সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ যেমন পেট্রোলের ঘাটতিও রয়েছে। আমি সিলেটের কাছাকাছি তাদের একটি গুদামঘরের ডিপো পরিভ্রমন করেছি যাতে অসফল ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা বোমা বর্ষণ করা হয়েছিল। শেষ কয়েকশত গ্যালন সরবরাহ নিচে চাপা পড়েছে।

সকল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে মুক্তি ফৌজ সেনাবাহিনীকে ধরে রাখতে পেরেছে। যাদের কাছে তাদের তুলনায় উচ্চতর অস্ত্রশক্তি এবং দক্ষ বাহিনী রয়েছে এবং তা ক্রমাগত আকাশ পথে পুনরায় সজ্জিত করা হচ্ছে।

বেসামরিক নাগরিকদের জবাই
মুক্তি ফৌজের নেতারা বলেছেন এটা হচ্ছে কারন তারা একটি কারনে যুদ্ধ করছে।
সেনাবাহিনীর একমাত্র কৌশল হলো বেসামরিক জনগণকে সর্বোচ্চ রকমের যন্ত্রণা দেয়া এবং এই অঞ্ছলে দীর্ঘস্থায়ী ধ্বংস বিদ্যমান রাখা। সৈন্যদের লক্ষন দেখলে বুঝা যায় তারা নির্দিষ্ট আদেশ অনুযায়ী অন্ধভাবে পরিপূর্ণ বাড়িগুলিতে গুলি বর্ষণ করছে, সম্পূর্ণ গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং বাসিন্দাদের জবাই করছে যাতে তারা পালিয়ে যায়।

তারা ছত্রাকে বৃহত্তর স্থাপনা যেমন আলোক শিল্প ধ্বংস করে ফেলেছে এবং ১০ টি প্রধান পূর্ব পাকিস্তানের জুট কারখানা যা শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানেরই নয় সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল ভিত্তিও।
পরিষ্কারভাবেই সেনাবাহিনীর লক্ষ্য ছিল প্রথম হামলার ৪৮ ঘণ্টার মাঝেই জনগণের মনোবল ভেঙ্গে ফেলা।

এটা ব্যর্থ হয় কিন্তু সরকার এই অকার্যকর কৌশলের সাথেই চলতে থাকে। যা সিলেটের মত পূর্ব পাকিস্তানে অন্যান্য প্রধান শহরগুলোকে ভূত প্রেতাত্মাময় নগরে পরিনত করে।

প্রায় সম্পূর্ণ ৭০০০০০ জন জনগণ পার্শ্ববর্তী গ্রামে পালিয়ে গেছে। রাস্তাগুলিতে অসহায় বৃদ্ধ, পঙ্গু ও লাশ ফেলে রেখেছে বন্য কুকুর ও শুকুনের সাথে।

স্ফীত লাশগুলো সিলেটের মাঝে দিয়ে সুরমা নদীতে বয়ে চলেছে যা ২৬শে মার্চ রাতের প্রমান বয়ে চলছে যখন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা শহরের মাঝে ফেটে পড়ে এবং লুটপাট এবং জবাইয়ের প্রচারাভিযান শুরু করে।

বিশেষ ইউনিটকে ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিক, শিক্ষক এবং অন্যান্য পেশাদার মানুষকে হত্যার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়।

প্রতিরোধের লিংক
কিং ব্রিজটি নিয়ে এখন যুদ্ধ হচ্ছে যা সিলেটকে দুই অর্ধেকে সংযুক্ত করে। যদি সৈন্যরা ব্রিজটি ধ্বংস করতে সফল হয় তাহলে তা বাংলাদেশের প্রধান প্রতিরোধের লিংক ছিন্ন করতে পারবে।
যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য তার মান ছোট মনে হতে পারে যার শক্তি মনে হচ্ছে বাকি রয়ে গেছে যা মুক্তি ফৌজকে কম চাপ দিবে।

গ্রামাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ আনার সেনাবাহিনীর কোন আশাই নেই। ইতিমধ্যে ভারী বর্ষাকালীন বৃষ্টি চলাচল কঠিন করেছে এবং জনগণও তাদের প্রতিকূলে রয়েছে।

গত মাসে যখন বৃষ্টি সত্যি সত্যি শুরু হয় যা পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসবে আর তা সপ্তাহেও শেষ হবে না তখন সেনাবাহিনী পুরোপুরি কাদায় নিম্মজিত হবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!