You dont have javascript enabled! Please enable it!
অবতারণা
মানিব জাতির ইতিহাসে যতাে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহতার দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। স্বল্পতম সময়ে বাংলাদেশে বাংলাদেশের মতাে এতাে ব্যাপক নরহত্যাযজ্ঞ বিশ্বেও আর কোন দেশে সংঘটিত হয় নি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার লােক প্রাণ হারিয়েছেন। হত্যা করেছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তার এদেশীয় দালালরা রাজাকার, আলবদর, আলশামস, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং শান্তি কমিটির ঘাতকরা। মানব জাতির ইতিহাসে গণহত্যাযজ্ঞের খতিয়ানে দৈনিক গড় নিহতের সংখ্যায় এটাই সর্বোচ্চ। এ রিপাের্ট জাতিসংঘের ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর। মাসে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণার তেত্রিশতম বার্ষিকীতে জাতিসংঘ এই রিপাের্ট প্রকাশ করে। তাতে নিহতদের সংখ্যা সর্বনিম অন্তত পনের লক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়। নতুন প্রজন্মের নাগরিক যারা, বয়স যাদের আঠারাে, বিশ কিংবা বাইশ; সেই ন’মাসের ভয়ঙ্কর বিভীষিকার ভয়াবহতা কোনক্রমেই তাদের উপলব্ধিতে আসতে পারে। মৃত্যু এবং মৃত্যু, লাশ এবং লাশ হয়ে যাওয়া, এই ছিল সেসব দিনের রােজনামচা। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম ভাষার সকল শব্দ উজাড় করে দিলেও নব প্রজন্মের বােধের তন্ত্রীতে। সেই দুঃস্বপ্নময় অসাড় করা দিন-রাত্রির চিত্র তুল ধরা যাবে না। ছয়শ’ বছর পর এই বাংলার সবুজ মাটিতে কবর থেকে ওঠে আসে যেন তৈমুরের প্রেতাত্মারা । নির্বিচারে হত্যা করে নারী-পুরুষ-শিশু-যুবা-বৃদ্ধা । জান্তব হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি নারীর ওপর। জ্বালিয়ে দেয় কৃষকের পর্ণ কুটির। লুণ্ঠন করে গরিব কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের সঞ্চিত সম্পদ। ‘কাফের’ আখ্যায়িত করে মসজিদ থেকে টেনে এনে হত্যা করে ইমামকে, হত্যা করে মুসল্লিকে। যেমন করে দিল্লীর জামে মসজিদে ঢুকে তৈমুর। হত্যা করেছিলেন মুসল্লিদের; প্রাণভয়ে ভীত দিল্লীর নিরীহ মানুষদের।
আর সেই নারকীয় হত্যালীলার যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য তৈমুর যেমন বলেছিলেন— যা ঘটেছে। তা আল্লাহর নির্দেশেই, আমার কোন হাত নেই । ঠিক একই সুর ধ্বনিত হয় ছয়শ’ বছর পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্যাঙ্গাত মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলামীর ঘাতকদের কণ্ঠে, “কোন দেশ তার নিজের দেশের লােকদের দ্বারা শাসিত হলেই আজাদ হবে, সাধারণ আজাদীর এই সংজ্ঞা ইসলাম স্বীকার করে না। বাংলাদেশ বাঙালিদের দ্বারা শাসিত হবে এ মতবাদ শেখ মুজিব বা শ্রী তাজউদ্দীনের  কিন্তু মুসলমান আল্লাহর হুকুম পালন করার সুযােগ লাভকেই সত্যিকারের আজাদী মনে করে  এ ভিত্তিতে শাসক নিজের দেশের হােক বা বিদেশী হােক, তা লক্ষণীয় নয়।”(১) এই তৈমুরীয় মুসলমানরা তাদের আল্লাহর হুকুম পালনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যা, লুণ্ঠন ও নারী ধর্ষণে সহায়তা করে । তৈমুরীয় ভাষায় লুণ্ঠনের মাল জায়েজ করে ‘মাল-এ-গণিমত (যুদ্ধলব্ধ মাল)’ ফতােয়া দিয়ে ।(২)
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের এই বর্বরতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর উপমহাদেশের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হয়, তারই পরিণতি এটা । যুদ্ধের পর পরাশক্তি রাজনীতি অর্থাৎ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা নতুন প্রেক্ষাপট জন্ম দেয়। এই প্রেক্ষাপট হচ্ছে ১৯৬২ সাল থেকে উপমহাদেশের রাজনীতিতে সিআইএ (মার্কিন কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা) এবং ভারতীয় কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার (পরে ১৯৬৮ সাল থেকে রিসার্চ এ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং- সংক্ষেপে ‘র’) কার্যকলাপের ইতিহাস। সে ইতিহাস পর্দার আড়ালের ইতিহাস। অর্থাৎ ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের পর থেকে শুরু করে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই দুই গােয়েন্দা সংস্থা যে ষড়যন্ত্র করে, তারই ইতিহাস। এবং আজ পর্যন্ত যেটা পর্দার আড়ালেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঠিক ইতিহাস অনুসন্ধানে একজন ইতিহাসের ছাত্রকে তাই এদের ষড়যন্ত্রকে জানতে হয়। জানতে তাকে আসতে হয় ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে সিআইএ এবং ভারতীয় কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা তথা ‘র’-এর ষড়যন্ত্রের কাহিনীতে যা রচিত হয় পর্দার আড়ালে। আমরা সেই কাজটিই। করার চেষ্টা করবাে।
 
—————————————————
১. ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ২৫তম আজাদী দিবস উপলক্ষে জমিয়তে তালয়ে। আরাবিয়া আয়ােজিত ইসলামিক একাডেমিতে অনুষ্ঠিত আলােচনা সভায় জামায়েতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির আমীর গোলাম আজমের ভাষণ । (দৈনিক সংগ্রাম ১৬ আগস্ট ১৯৭১)
২. শর্ষিণার পীর আবু জাফর মােহাম্মদ সালেহর দালালি সম্পর্কে দৈনিক পূর্বদেশ-এ প্রকাশিত একটি চিঠি “এই ভণ্ডপীর হিন্দুদের মাল-সম্পত্তি এমনকি হিন্দু মেয়েদেরও (মাল-এ-গণিমত) যুদ্ধলব্ধ মাল হিসেবে ফতােয়া দেয়। একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায় পৃ: ৯৩-৯৪।

সূত্রঃ   বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!