You dont have javascript enabled! Please enable it!

অপারেশন সুখানপুকুর রেল স্টেশন (সকল পর্ব একসাথে)

ছবিটি যার; ঘটনাটি তাঁরই নিজের হাতে লেখা। (বীর মুক্তিযোদ্ধা Nobel)

:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::

সাবগ্রাম মাইন হামলার পর আমাদের লিডার ওয়ালেস ভাই পরবর্তী টার্গেট ঠিক করলেন সুখানপুর রেল স্টেশন। সে সময় আমাদের মুল দলের অবস্থান ছিল পূর্ব বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার অন্তর্গত ”নারচী” গ্রামে; আমাদের এক সহযোদ্ধা কিছলু ভাইয়ের দাদার বাড়ীতে। নারচী থেকে ”সুখান পুকুর” রেল স্টেশনের দুরত্ব প্রায় ৬ থেকে ৭ মাইলের মত।
ওয়ালেস ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন, অপারেশনের সুবিধার্থে আমাদের সুখান পুকুর রেল স্টেশনের যত কাছে সম্ভব এগিয়ে গিয়ে অবস্থান নিতে হবে। সুখান পুকুর রেল স্টেশনের লাগোয়া একটি গ্রাম শিহিপুর, এই শিহিপুর গ্রামের সরকার পাড়ার ভোলা সরকার আমাদের এক সহযোগী নওয়াজ ভাইয়ের খালু। ভোলা সরকার এলাকার একজন গন্যমান্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাঁর দ্বার ছিল অবারিত। নওয়াজ ভাই ও তাদের পুরো পরিবার এই বাড়ীতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে আমরা দুই বার এ বাড়ীতে সেল্টার নিয়েছি। ভারতে যাওয়ার পুর্বে এ বাড়ীতেই আমরা সবাই সমবেত হয়েছিলাম এবং এ বাড়ী থেকেই আমরা সবাই ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম।
ওয়ালেস ভাই ঠিক করলেন আমরা প্রথমে ভোলা সরকার সাহেবের বাসায় সেল্টার নিব, তারপর সুখান পুকুর স্টেশন ভালভাবে রেকি (পর্যবেক্ষন) করে প্ল্যান অব একশন ঠিক করবো। সিদ্ধান্ত হল পরদিন ভোরে আমি শিহিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিব, নওয়াজ ভাইয়ের সাথে দেখা করে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করে বিকেলের মধ্যেই নারচি ফিরে আসবো।
প্ল্যান অনুযায়ী পরদিন ভোরে আমি শিহিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। পথে করমজা হাটে একটি মিষ্টির দোকানে নাস্তা সেরে নৌকা করে করমজা নদী পেরিয়ে আবার পথ ধরলাম। সকাল দশটার দিকে শিহিপুর পৌঁছে গেলাম। সরকার সাহেবের বাড়ী রেল লাইনের একদম কাছে, রেল লাইন থেকে বাড়ীর দুরত্ব একশ কি দেড়শ গজের মত হবে, মাঝে পুরোটাই ধানক্ষেত। রেল লাইন থেকে সরকার সাহেবের বাড়ী স্পষ্ট দেখা যায়।
নওয়াজ ভাই ও আর একজন ছেলেকে দেখলাম বাড়ীর সামনের বারান্দায় একটা বেঞ্চে বসে আছেন। দুর থেকে নওয়াজ ভাই আমাকে লক্ষ্য করছিলেন, কাছে যেতেই সঙ্গের ছেলেটিকে বললেন, তুই এখানে বসে চারিদিকে খেয়াল রাখ, আর আমাকে বললেন ভিতরে চলো। ঘরে ঢুকেই নওয়াজ ভাই কে জিজ্ঞাসা করলাম কি ব্যাপার নওয়াজ ভাই, ”কোন সমস্যা?” ”আর বলো না, মাঝে মধ্যেই পাকিস্তানি আর্মি ট্রেন থামিয়ে আশেপাশের গ্রামে ঢুকে পড়ে, যুবক ছেলেদের পেলে গুলি করে মেরে ফেলে। যুবতী মেয়ে পেলে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাছাড়া গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী যা পায় নিয়ে যায়। এছাড়া রাজাকারের বাচ্চারাতো আছেই, কয়েকদিন হল আবার সুখান পুকুর স্টেশনে ক্যাম্প করেছে, প্রায়ই এদিকে আসে হাঁস, মুরগী আর ছাগলের খোঁজে। আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি। রেডি থাকি সব সময়, যেন সে রকম দেখলেই পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারি। তাই সামনের বারান্দায় কাওকে না কাওকে পাহারায় থাকতে হয়। সে যাই হোক, তোমাদের খবর বল। আর সবাই কোথায়”? ”আমি কিছু একটা জবাব দেওয়ার আগেই ঝড়ের বেগে খালাম্মা (নওয়াজ ভাইয়ের মা) ঘরে প্রবেশ করলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, ”কি ব্যাপার নোবেল, তুমি একা, খসরু, সিদ্দিক এরা কোথায়?” আমি জানতাম আমাকে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে। মানসিক ভাবে প্রস্তুতও ছিলাম। তার পরেও একটু থতমত খেয়ে গেলাম জবাব দিতে গিয়ে। আসলে ব্যপারটা হচ্ছে, ’খসরু’ নওয়াজ ভাইয়ের ছোট ভাই আর ’সিদ্দিক’ ফুপাতো ভাই। খসরু, সিদ্দিক ও আমি প্রায় সমবয়সী এবং ঘনিষ্ট বন্ধু। বগুড়া শহরে একই পাড়ায় আমাদের বাড়ী। অমরা ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছি। ওয়ালেস ভাইয়েরাও এক সময় বগুড়ায় খসরুদের বাড়ীতে ভাড়া থাকতেন। সরকার সাহেবের এই শিহিপুরের বাড়ী থেকেই আমরা পাঁচ জন ওয়ালেস ভাই, মজ্ঞু ভাই, খসরু, সিদ্দিক ও আমি এক সাথে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।
(….ক্রমশ)

দ্বিতীয় পর্ব
ভারতে পৌঁছে আমরা প্রথমে “কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে” যোগদান করি। এর চার পাঁচ দিন পরেই আরশাদ ভাই ও টিপু আমাদের সাথে যোগ দেয়। কয়েকদিন ট্রেনিং নেয়ার পর, ওয়ালেস ভাইয়ের পক্ষে বিশেষ কোন কারনে ক্যাম্পে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ওয়ালেস ভাই আমাদের রেখে চলে যান তরঙ্গপুর সাত নাম্বার সেক্টরের হেড কোর্য়াটারে, সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। এর কিছুদিন পর এক ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি, খসরু, সিদ্দিক ও টিপু ক্যাম্পে নেই এবং সেই সাথে ক্যাম্পের আরো কিছু ছেলে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। সবাই বলাবলি করছে ওরা নাকি “মুজিব বাহিনীতে” যোগ দিতে গিয়েছে। যাইহোক, যেদিন ভোররাত্রে খসরুরা ক্যাম্প ত্যাগ করে, সেদিনই সেভেন সেক্টর হেড কোর্য়াটার থেকে একটা ট্রাক আসে কামারপাড়া ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে একটা চিঠি নিয়ে। চিঠিতে নির্দেশ ছিল, আরশাদ, টিপু, খসরু, সিদ্দিক ও নোবেল যেন অতি সত্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে গিয়ে রিপোর্ট করে। টিপু, খসরু ও সিদ্দিক তো নেই কাজেই আরশাদ ভাই ও আমি ঐ ট্রাকেই চলে যাই সেক্টর হেড কোর্য়াটারে। সেখানে ওয়ালেস ভাই অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক সাহেব আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “বাকী তিনজন কোথায়?” আমরা সবকিছু খুলে বললাম। শুনে তিনি মন্তব্য করলেন, “ও, এরা তাহলে বি.এল.এফ এ যোগ দিয়েছে”। যাই হোক, শুরু হয়ে গেল আমাদের ট্রেনিং মেজর নাজমুল হক সাহেবের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষনে, সেভেন সেক্টর হেড কোয়ার্টারে।
খালাম্মাকে আমি বললাম, খসরু, সিদ্দিক ও টিপু হায়ার ট্রেনিং নেয়ার জন্য এখনো ভারতে রয়ে গিয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে ওরাও বাংলাদেশে ঢুকবে। আপনি কোন চিন্তা করেবেন না, সবাই ভালো আছে। খালাম্মাকে আর কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি বললাম- আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে, মুড়ি-টুড়ি কিছু খাকলে দেন, আমি একটু পরেই চলে যাব। “বোসো তুমি” বলেই খালাম্মা দ্রুত চলে গেলেন ।
খালাম্মাকে বিদায় করে আমি নওয়াজ ভাইয়ের সাথে কাজের কথা শুরু করলাম। বল্লাম, “আজ শেষ রাতের দিকে আমরা পাঁচ সাত জন আপনাদের বাসায় সেল্টার নিতে চাই, দুই-এক দিন থাকতে হতে পারে, আপনাদের কোন সমস্যা হবে কিনা, ওয়ালেস ভাই জানতে চেয়েছেন।” নওয়াজ ভাই সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন, “আমাদের কোন সমস্যা নেই। তোমরা চলে আসো, আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো।” আরো কিছু আলাপ আলোচনার পর আমি চলে আসতে চাইলাম কিন্তু খালাম্মা কিছুতেই দুপুরের খাবার না খাইয়ে ছাড়লেন না।
আকাশ মেঘলা দেখে নওয়াজ ভাই আমাকে একটা ছাতা দিতে চাইলেন। কিন্তু আমি না করলাম, বললাম, “ধুর বৃষ্টি আসবে না, খামোখা এই ঝামেলাটা নিতে চাই না।” তাছাড়া আমি ছাতা হারিয়ে ফেলি। এই দুর্দিনে একটা ছাতা হারালে অনেক সমস্যা হবে। বিধি বাম, আমার ভবিষ্যত বানীকে মিথ্যা প্রমানিত করে করমজা খেয়া ঘাটে আসতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। খেয়া ঘাটের ছাপড়ায় অশ্রয় নিলাম। ঘন্টা খানিক অপেক্ষা করেও বৃষ্টি থামার কোন লক্ষন নেই দেখে, “ধুর ছাই” বলে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আবার নারচির পথ ধরলাম।
সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ নারচি তে পৌঁছেই ওয়ালেস ভাইকে বিস্তারিত রিপোর্ট করলাম। সব শুনে ওয়ালেস ভাই বললেন, “ওকে, রাত এগারোটায় রওনা হবো। তুমি যাও রেস্ট নাও, ও হ্যাঁ আরশাদের জ্বর এসেছে, তুমি আবার জ্বর বাঁধিয়ো না। গা, হাত-পা ভালোভাবে মুছে নাও।”

তৃতীয় পর্ব
ভিতরের ঘরে গিয়ে দেখি আরশাদ ভাই শুয়ে আছেন, গায়ে হাত দিয়ে দেখি, বেশ জ্বর। আমার স্পর্শে চোখ মেলে চাইলেন, জিজ্ঞেস করলেন কখন ফিরলে। বললাম এই তো, তা তোমার হঠাৎ জ্বর? আরশাদ ভাই মনে হল তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, বললেন, কোথায় জ্বর, সামান্য একটু গা গরম হয়েছে। আর অমনি উনার ডাক্তারী বিদ্যা উথলে উঠলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম কার কথা বলছো? কার আবার, আমাদের লিডার ডাঃ ওয়ালেস, আরে বাবা আগে ডাক্তার হও তারপর না হয় ডাক্তারী করতে আসো, তুমিও যেমন ঢাকা মেডিকেলে পড় আমিও তেমনি ঢাকা মেডিকেলে পড়ি, না হয় তুমি থার্ড ইয়ারে, আর অমি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, তাই বলে কি আমি বুঝি না আমার জ্বর কিনা? জিজ্ঞেস করলাম হয়েছেটা কি? কি আর হবে, ঔষধ দিয়ে বললেন নিয়ম মত খাও আর কমপ্লিট রেস্ট, আপাতত কোথাও কোন অপারেশনে তুমি যাচ্ছো না। এতক্ষনে আরশাদ ভাই -এর রাগের কারনটা বোঝা গেল, উনার অপারেশনে যাওয়া বন্ধ। আমি হেসে ফেললাম, বললাম, দেশতো আর ফট করে স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে না, বেঁচে থাকলে অনেক সুযোগ পাবে অপারেশনের। এর মধ্যে কিছলু ভাই ঘরে ঢুকলেন গজ গজ করতে করতে। জিজ্ঞেস করলাম – কিছলু ভাই আপনার আবার কি হল? “আমি তোর থেকে ছয় বছরের বড়, তোকে কোলে নিয়ে বেরিয়েছি। ছোট বেলায় তুই আমার কোলে হিসি করে দিয়েছিস, আজ তুই আমাকেই ধমক দিস?” ফেটে পড়লেন কিসলু ভাই। কে আবার অপনাকে ধমকালো? কে আবার ক…মা…ন্ডা….র ওয়ালেছ। আরে বাপ ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলাম – ওয়ালেস, আমরা কয়টার সময় রওনা দিচ্ছি? আমাকে ধমক দিয়ে বলে, “আপনাকে বলেছি নাকি যে, আপনি আমাদের সাথে যাচ্ছেন, নাকি আপনাকে রেডি হতে বলেছি? ভেতরে যান, সবার খাবার দাবারের ব্যবস্থা দেখেন। আপনি কোথাও যাচ্ছেন না। ক্যাম্পে থাকবেন।” গজ গজ করতে লাগলেন কিছলু ভাই।
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে অমরা ছয়জন ঠিক রাত এগারোটায় রওনা হয়ে গেলাম শিহিপুরের উদ্দেশ্যে। এই ছয় জনের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি।
ওয়ালেস ভাইঃ আমাদের লিডার। বগুড়া শহরের সূত্রাপুরে বাড়ী। ঢাকা মেডিকেলে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। দুর্দান্ত সাহস আর তীক্ষ বুদ্ধির অধিকারী। সিক্স সেন্স অসম্ভব প্রখর। আগে থেকেই বিপদ টের পাওয়ার অসম্ভব একটা গুন রয়েছে। কষ্ট সহিষ্ণুœ ও শক্তিশালী। বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত।
মন্ডল ভাইঃ বগুড়ার কইচর গ্রামে বাড়ী। ঢাকা ইউনিভার্সিটির অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র। বাবু ও মন্ডলকে সে সময় ইউনিভার্সিটির সবাই এক ডাকে চিনতো। লম্বা, সুঠাম, শক্তিশালী ও কষ্ট সহিষ্ণুœ।
মুকুলঃ বগুড়ার সরিষা কান্দি চর এলাকায় বাড়ী। লম্বা, শক্তিশালী, সুঠাম দেহ। বি.এ. ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত।
ফরহাদঃ কিছলু ভাইয়ের ছোট ভাই। বগুড়া শহরের সূত্রাপুরে বাড়ী। ছাট খাটো হালকা পাতলা দেহ। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। অতি বাম রাজনীতির সাথে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বেই গোটা তিনেক র্মাডার কেসের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। অসম্ভব সাহসী।
ফজলুঃ করমজা হাটের পাশে, শেখাহাটি গামে বাড়ী। বয়স আনুমানিক বিশ/বাইশ হবে। লম্বায় মাঝারী কিন্ত চওড়ায় বিশাল। পেটানো শরীর। গায়ে অশূরের শক্তি । আমাদের সমস্ত ভারী কাজ সে একাই করে। লেখাপডা করেনি বললেই চলে। একটু ক্ষেপাটে ধরনের, আমরা বলি, ফজলু পাগলা। এল.এম.জি. চালনায় সে আমার সহকারী, গুলির ম্যগজিনগুলো সে বহন করে সংগে একটা .৩০৩ রাইফেল রাখে। এল.এম.জি. সহকারী তাই সে আমাকে ওস্তাদ বলে ডাকে।
নোবেল (আমি)ঃ বগুড়া শহরের সূত্রাপুরে বাড়ী। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত। হালকা পাতলা গড়নের।
আমার হাতে একটা ব্রিটিশ এল.এম.জি. প্রায় ২৩ পাউন্ড ওজন, .৩০৩ রাইফেলের গুলি এলাউ করে, ম্যাগজিন (বক্স) সিষ্টেম। ইফেকটিভ ফায়ারিং রেন্জ ৬০০ গজ, ম্যক্সিমাম ফায়ারিং রেন্জ ১৮৫০ গজ। আর বাকি সবার হাতে একটা করে .৩০৩ মার্ক ৪ রাইফেল। শুধু ফজলু পাগলার কাছে রাইফেল ছাড়াও ঘাড়ে একটা বস্তা, তাতে হ্যান্ড গ্রেনেড ও ছয়টা লোডেড এল.এম.জি.’র ম্যাগজিন।
করমজা হাট পর্যন্ত আমরা বেশ ঢিলে-ঢালা ভাবেই গেলাম। কিন্তু নদী পেরিয়েই সতর্ক হয়ে এগুতে লাগলাম। রাস্তার এক পাশে তিন জন অপর পাশে তিনজন, একজনের থেকে আরেকজন বেশ কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম। বিড়ি সিগারেট খাওয়ারতো কোন প্রশ্নই আসে না। রাত প্রায় তিনটার দিকে আমরা এক প্রকার নির্বিঘেœই শিহিপুর পৌঁছে গেলাম। নওয়াজ ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। খাওয়া দাওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। আমরা ঝটপট কিছু মুখে দিয়েই শুয়ে পড়লাম। শুধু মন্ডল ভাই ও ফরহাদ এর উপর দ্বায়িত্ব পড়লো গার্ড দেওয়ার জন্য।
সকাল ন’টার দিকে আমি আর ওয়ালেছ ভাই নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম সুখান পুকুরের উদ্দেশ্যে, চারদিকের একটু খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। সরকার সাহেবের বাড়ী থেকে স্টেশনের দুরত্ব প্রায় দেড় মাইলের মত। ওয়ালেস ভাই সামনে আর আমি প্রায় চল্লিশ গজ দুরত্ব রেখে ওয়ালেস ভাইকে অনুসরণ করে চলেছি। আমাদের দু’জনের কারও কাছে কোন অস্ত্র নেই, ক্রমশঃই শত্রুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, খালি হাতে। আমার বেশ অস্বস্তি লাগছিল, কিন্তু কি আর করা! ওয়ালেছ ভাই স্টেশনের দিকে না গিয়ে বন্দরের ভিতরে ঢুকে গেলেন, ধীরে সুস্থে চারিদিকে লক্ষ্য রেখে এগিয়ে চললাম। ওয়ালেস ভাই হঠাৎ করে একটা আড়তের ভিতরে প্রবেশ করলেন, আমিও ওয়ালেস ভাইকে অনুসরন করে আড়তের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ওয়ালেস ভাই, আমি ঢুকতেই আমাকে ঈশারা করে আড়তের পিছনের একটা দরজা দিয়ে ছোট একটা ঘরে ঢুকে পড়লেন। পিছে পিছে আমিও ঢুকে পড়লাম। ঘরের ভিতর ছোট্ট একটা চৌকিতে ফর্সা, সুন্দর একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। আমাদের দেখে বসতে বলেই ভদ্রলোক চট করে বাহিরে চলে গেলেন, একটু পরে ফিরে এসে বললেন বাইরে একটু ব্যবস্থা করে এলাম। তারপর ওয়ালেস ভায়ের দিকে তাকিয়ে একটা সুন্দর হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তারপর ওয়ালেস কি উদ্দেশ্যে? তোমার খবর আমি আগেই পেয়েছি, বল কি কাজে লাগতে পারি?” আগে বলেন আপনি কেমন আছেন হাল্লু ভাই, সব খবর ভালো তো? পালটা প্রশ্ন করলেন ওয়ালেস ভাই। আর খবর, হারামজাদা রাজাকারদের জ্বালায় একদম অতিষ্ট হয়ে গেলাম। কিছুদিন হল এখানে ক্যাম্প করেছে, মাঝে মাঝে আবার মিলিটারীরাও আসে। কথার ফাঁকে ফাঁকে ভদ্রলোক আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন কিন্তু কোন প্রশ্ন করলেন না। এক পর্যায়ে ওয়ালেস ভাই ভদ্রলোককে বললেন, হাল্লু ভাই, আমরা এসেছি আপনাদের এই রেল স্টেশন ও আশপাশ এলাকা রেকি করার জন্য। “রেকি” কি? হাল্লু ভাইয়ের সরল প্রশ্ন। “রেকি করা মানে হল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শত্রু পক্ষের লে-আউট, লোকবল, অস্ত্রের পজিশন ও আক্রমনের জন্য সম্ভাব্য গমন ও নিঃগমনের পথ দেখে আসা। এর জন্য যতদুর পারা যায় শত্রুর কাছাকাছি যেতে হবে।“ ওয়ালেস ভাই অল্প কথায় বুঝিয়ে বললেন। “তার মানে তোমরা হামলা করতে যাচ্ছো!” চাপা স্বরে হাল্লু ভাই উচ্ছাস প্রকাশ করলেন।

চতুর্থ পর্ব
হাল্লু ভাইয়ের থেকে মোটামুটি একটা গাইড লাইন নিয়ে আমি আর ওয়ালেস ভাই চললাম রেকি করার জন্য। আমাদের দুজনের পরনেই ছিল লুঙ্গি ও সার্ট (গ্রামের লোকরা সে সময় যে ধরনের সার্ট পরতেন, আধা বুক ফাড়া, বুকে এবং দুপাশে দুটি পকেট ওয়ালা ঢোলা হাফ সার্ট)। মোটামুটি গ্রামের লোকজনের থেকে আমাদেরকে প্রথম দৃষ্টিতেই আলাদা করে চেনার উপায় নেই।
হাল্লু ভাইয়ের আড়তের সামনের রাস্তাটা বন্দরের ভিতর দিয়ে সোজা গিয়ে ঠেকেছে রেল স্টেশনে। এই রাস্তাটা দিয়েই আমরা গিয়ে ঢুকলাম স্টেশনের ভিতর। ১৫/২০ জন মানুষ ঘোরাঘুরি করছে প্ল্যাটফর্মে, সম্ভবত ট্রেন আসার সময় হয়ে গিয়েছে। মোটামুটি সবাই বয়স্ক ও টুপি, দাড়ীওয়ালা। সর্বমোট তিনজন রাজাকারকে দেখলাম .৩০৩ রাইফেল ঘাড়ে ঝুলিয়ে বেশ ভাব নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। কোন ”ডিফেন্স পোস্ট” চোখে পড়লো না। স্টেশন থেকে প্রায় ২৫০ গজ পশ্চিমে (বগুড়া শহরের দিকে) একটা মেঠো পথ গাবতলীর (বগুড়ার) দিক থেকে এসে রেল লাইনকে ক্রস করে সুখানপুকুর বন্দরের ভিতর দিয়ে করমজা হাটের দিকে চলে গিয়েছে। রাস্তাটা যেখানে রেল লাইনকে ক্রস করেছে সেখানে রেল লাইনের দক্ষিন পাশ ঘেঁেস ও রাস্তার পশ্চিম পাশে একটা ঘুমটি ঘর । আমরা রেল লাইনের পাশ দিয়ে সেই ঘুমটি ঘরের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলাম। কয়েকজন রাজাকারকে দেখলাম ঘুমটি ঘরের পাশে রেল ক্রসিং এর উপরে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঘোরাফেরা করছে। তবে কারও হাতে কোন অস্ত্র্র দেখতে পেলাম না। এরা সম্ভবতঃ রাস্তায় চলাচলকারী মানুষ-জন কিংবা গরু-মহিষের গাড়ী সন্দেহ হলে চেক করে। আর একটু এগুতেই চোখে পড়লো রেল লাইনের উত্তর ও রা¯তার পূর্ব পাশে একটা গুদাম ঘর। গুদাম ঘরটি রেল লাইন থেকে একটু দুরে। গুদাম ঘরের সামনেও দেখলাম দশ-বারো জন রাজাকার ও কমপক্ষে তিন জন প্রায় কালো রংয়ের ইউনিফর্ম, দুর থেকে ঠিক বুঝলাম না এরা কারা। ঘুমটি ঘরের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলাম ঘুমটি ঘরের ভিতরে চার কি পাঁচটা .৩০৩ রাইফেল সারিবদ্ধভাবে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো। আমরা রাজাকারদের পাশ দিয়ে রেল লাইন ছেড়ে মেঠো পথ ধরে বন্দরের দিকে চলে আসলাম। আল্লাহকে ধন্যবাদ রাজাকাররা আমাদেরকে কোন প্রশ্ন করলো না। লক্ষ্য করলাম রেল লাইন থেকে বন্দর পর্যন্ত রাস্তার ডান (পশ্চিম) পাশে অর্থাৎ ঘুমটি ঘরের পেছনে পুরোটাই পাট ক্ষেত। বন্দরে ঢুকে ওয়ালেস ভাই আমাকে বললেন, ”তুমি শিহিপুর চলে যাও, আমি হাল্লু ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলেই চলে আসছি।”
শিহিপুরে সবাই আমাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। যেতেই মন্ডল ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, ”ওয়ালেস কই?” বললাম, আসছে, চিন্তার কোন কারন নাই।
আধা ঘন্টার মধ্যেই ওয়ালেস ভাই ফিরে আসলেন। এসেই নওয়াজ ভাইকে বললেন কাগজ ও পেন্সিল দিতে। কাগজ পেন্সিল হাতে পেয়েই ওয়ালেস ভাই সুন্দর করে রেল স্টেশন, ঘুমটি ঘর, গুদাম ঘর, হাল্লু ভাইয়ের আড়ত , রেল লাইন, মেঠো পথ এসবের অবস্থান এবং আনুমানিক দুরত্ব দেখিয়ে একটা নক্সা একে ফেললেন। তারপর ধীরে ধীরে মাথাটা উঁচু করে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ”আমরা আগামী দুই ঘন্টার মধ্যে সুখানপুকুর রেল স্টেশনে হামলা করতে যাচ্ছি।” ঘরের মাঝে বজ্রপাত হলেও বুঝি কেই এতোটা চমকাতো না। মন্ডল ভাই ই প্রথম সামলিয়ে নিলেন। মৃদুভাষী মন্ডল ভাইও একটু উঁচু স্বরে বললেন, ”গড ড্যাম ইট ওয়ালেস, তুই দিনের আলোয় হামলা করতে চাচ্ছিস? অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে দিনের আলোয় যদি আমরা এ বাড়ী থেকে বেরিয়ে স্টেশন এ্যাটাক করি, আমি নিশ্চিত আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে এ বাড়ী পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, আর আমরা সেটা করতে পারি না”। ”আমরা কোন ফায়ার আর্মস নিয়ে হামলা করছি না” । দ্বিতীয় বজ্রপাত, মন্ডল ভাইয়ের চোয়াল ঝুলে পড়ল, ”তোর মাথা ঠিক আছে তো?” কোন মতে জিজ্ঞেস করলেন মন্ডল ভাই। ”কামঅন ম্যান, আগে প্ল্যানটা দেখ।” ওয়ালেস ভাই আমাদের প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিতে শুরু করলেন। প্রথমে আমরা সবাই একজন দুজন করে হাল্লু ভাইয়ের আড়তে একত্রিত হব। আমাদের দু’জন দুটো করে চারটে গ্রেনেড কোমরে লুকিয়ে নিয়ে রেল স্টেশন থেকে রেল লাইন ধরে সোজা ঘুমটি ঘরের দিকে এগিয়ে যাবে। একজন ঘুমটি ঘর লক্ষ্য করে অন্যজন গুদাম ঘর লক্ষ্য করে দু’টি করে চারটি গ্রেনেড চার্জ করবে। এ সুযোগে বাঁকি চারজন মেঠে পথ দিয়ে ঘুমটি ঘরের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাবে এবং ঘুমটি ঘরের রাইফেলগুলো কব্জা করে ফায়ারিং ওপেন করবে।” কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আমি বললাম, ”রাইফেল গুলোতে গুলি নাও থাকতে পারে।” ইয়েস, আমরা ধরেই নিচ্ছি, রাইফেল গুলোতে গুলি নেই, তাই আমরা এমোনিশন বেল্টে দশটা করে গুলি নিয়ে নিব। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ওয়ালেস ভাই বললেন ”তোমরা হয়তো ভাবছো রাতের আঁধারে পূর্ন শক্তি নিয়ে হামলা না করে দিনের আলোয় কেন শুধু গ্রেনেড নিয়ে হামলা করতে যাচ্ছি? প্রথমতঃ রাতে হামলা করলে স্টেশনটাকে আমরা কব্জা করে রাখতে পারবো না, কারন আমরা সংখ্যায় কম। আমাদের উপর চোরাগুপ্তা হামলা হতে পারে। দ্বিতীয়তঃ দিনে হামলা করলে রাজাকাররা আর সাহস পাবে না গ্রামে গ্রামে ঢুকে লুট পাট চালাতে। এছাড়া এই অপারেশনটা যদি আমরা সাকসেসফুল করতে পারি, তাহলে এর ইমপ্যাক্ট হবে সুদুর প্রসারী। কিছুক্ষন সবাই চুপচাপ খাকার পর মুকুল বললো, ”ঠিক আছে লিডার আমরা দিনের বেলায় হামলা করবো, তা গ্রেনেড চার্জ করার জন্য কে কে যাচ্ছে? উত্তরটা আমার জানা ছিল, কিন্তু কিছু বললাম না, ইতিমধ্যে ফজলু পাগলা হাত তুলেছে, ”হামি যামু”, ওয়ালেস ভাইয়ের ধমকে আবার হাত নামিয়ে নিল। ”গ্রেনেড চার্জ করার ট্রেনিং শুধু মুকুল, নোবেল ও আমার আছে, এ ক্ষেত্রে ট্রেনিং ছাড়া চার্জ করতে গেলে নিজেদেরই আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই নোবেল আর মুকুল যাচ্ছে গ্রেনেড চার্জ করতে। মন্ডল, ফরহাদ, ফজলু আর আমি যাবো রাইফেলগুলো কব্জা করতে”, বললেন ওয়ালেস ভাই। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ”ওয়ালেস ভাই আপনার প্ল্যানে ”সময়” কিন্তু একটা বড় ব্যাপার। সময় মত যদি আপনারা না আসতে পারেন সেক্ষেত্রে আমাকে আর মুকুলকে খরচের খাতায় ধরে লাখতে পারেন। আমার কথায় ওয়ালেস ভাই গম্ভীর হয়ে বললেন, ”মেজর নাজমুল হক সাহেবের হাতে গড়া ফাইটার তুমি, আর যাই হোক রাজাকারের গুলিতে মরবে না তুমি, সে বিশ্বাস আমার আছে। ”আরো কিছুক্ষন আলাপ আলোচনা চলার পর দুপুরের খাওয়া এসে গেল, খালাম¥া নিজেই তদারকি করলেন, মনে মনে ভাবলাম উনি যদি ঘুনাক্ষরেও জানতে পারতেন যাদেরকে তিনি এতো মমতায় খাওয়া”্ছনে, আর কিছুক্ষন পরে তারা কোন আগুনে ঝাপিয়ে পডবে।

পঞ্চম পর্ব

সবাই কোমরে এমুনেশন বেল্ট পরে নিলাম। আমাদের ঢোলা জামার নিচে বেল্ট গুলো ঢাকা পড়ে গেল। বেল্টে দু’টো করে গ্রেনেড আর দশ রাউন্ড করে .৩০৩ রাইফেলের গুলি। এক এক করে সবাই বেরিয়ে পড়লাম, একজন আরেকজনকে অনুসরন করছি, গন্তব্য হাল্লু ভাইয়ের আড়ত। কোন ঝামেলা ছাড়াই আমরা একে একে হাল্লু ভাইয়ের আড়তে পৌঁছে গেলাম। হাল্লু ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওয়ালেস ভাই জিজ্ঞেস করলেন, “সবকিছু ঠিকঠাক হাল্লু ভাই?” হাল্লু ভাই মাথা নেড়ে বললেন, “সব ঠিকঠাক, তোমার কথামত দু’টো পুরানো গামছা ও হাওলা পান্টি (গরু তাড়ানোর লাঠি) জোগাড় করে রেখেছি।” ওয়ালেস ভাই আর একবার ব্রিফ করলেন সবাইকে। তারপর আমাকে আর মুকুলকে বললেন, “গামছাটা মাথায় বেধে নাও আর হাওলা পান্টিটা হাতে রাখো। এখন ট্রেনের সময় না, কাজেই স্টেশন ফাঁকা থাকবে, রাজাকাররা তোমাদের চ্যালেঞ্জ করতে পারে, যদি করে, তাহলে বলবে গরু হারিয়ে গিয়েছে, খুঁজতে বেরিয়েছো।” লুঙ্গিটা ভালো করে গিঁট দিয়ে নিলাম, তারপর তামিল সিনেমার গুন্ডাদের মত খাটো করে নিয়ে আরো একটা গিট দিলাম, মাথার গামছাটা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে সবার সাথে হাত মিলিয়ে, আল্লাহ’র নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
স্টেশনে পৌঁছে দেখি, প্রায় ফাঁকা, দু’টো রাজাকারকে দেখলাম নিজেদের মাঝে গল্পে বিভোর, আমাদের দিকে ফিরেও তাকালো না। দেরি না করে আমরাও হাঁটা দিলাম ঘুমটি ঘরের দিকে। রেল লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি, পেছনে শত্রু রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? যদিও ওয়ালেস ভাইয়ের ধারনা এ্যাকশন শুরু হলে ওরা পালিয়ে যাবে, তারপরও এরা যদি এদিক থেকে ফায়ার ওপেন করে, যদিও অনেক দূর, তারপরও বেশ ঝামেলায় পড়ে যাবো। মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটা দূর করে দিলাম। ঢিল ছোঁড়া হয়ে গিয়েছে, এখন আর এসব ভেবে লাভ কি?
ঘুমটি ঘরের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি, আগের মতই বেশ কয়েকজন রাজাকার ঘুমটি ঘরের সামনে ঘোরাঘুরি করছে। আরো বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলে গ্রেনেড চার্জ করার মত দূরত্ব পেয়ে যাব। এই সময় বাঁধলো বিপত্তি।

ঘুমটি ঘরের দিক থেকে একটা ছেলে, সম্ভবতঃ রাজাকার, তবে হাতে কোন হাতিয়ার নেই, স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল, আমাদের পাশ কাটিয়ে যাবে কিন্তু বিশ-পঁচিশ হাত দূরে থাকতেই ব্রেক করে দাঁড়িয়ে গেল। আতঙ্কে চেখ দুটো বিস্ফারিত। “মুকুল ভাই, আপনি না ইন্ডিয়াত গেছেন মুক্তি হবার জন্যি”, তারপরেই ত্বারস্বরে চিৎকার, “মুক্তি বাহিনী, মুক্তি বাহিনী”। (ছেলেটি ছিল মুকুলের পরিচিত, রাজাকারে নাম লিখিয়েছে) ভ্যাবা চ্যাকা খেয়ে গেলাম আমরা। টার্গেট তখনো আমদের নাগালের বাহিরে, তা সত্বেও চিৎকার করে মুকুলকে বললাম, “চার্জ”, বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে সর্বশক্তিতে পর পর দু’টো গ্রেনেড ছুঁড়ে দিল মুকুল টার্গেটের দিকে, অর্থাৎ গুদাম ঘরের দিকে। চট করে লাইন পজিশনে চলে গেলাম আমরা দু’জন। মুকুল আমার চাইতে লম্বা ও শক্তিশালি, গ্রেনেড দু’টো প্রায় গুদাম ঘরের কাছাকাছি গিয়ে বিকট শব্দে বিস্ফারিত হলো। বিস্ফোরনের শব্দ কানে যেতেই বিদ্যুৎ বেগে উঠেই কুঁজো হয়ে দৌড় দিলাম। আমার টার্গেট ঘুমটি ঘরের দিকে, দৌড়াতে দৌড়াতেই বেল্ট থেকে একটা গ্রেনেড বের করে পিন খুলে ফেলেছি। রাজাকারদের দিকে তাকিয়ে দেখি অরাজক অবস্থা, কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। টার্গেট নাগালের মধ্যে আসতেই গ্রেনেডটি ছুঁড়ে দিয়েই লাইন পজিশনে চলে গেলাম। নিখুঁত নিশানা, ধনুকের মত বাঁক নিয়ে গ্রেনেডটি গিয়ে পড়লো ঠিক রাজাকারদের মাঝখানে। তারপর ঘুমটি ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে তিন চারটা গড়ান দিয়ে ঠিক ঘুমটি ঘরের দরজার কাছে গ্যাট হয়ে বসে গেল। হতভম্ব হয়ে গেলাম, নিজের চোখ দু’টোকে বিশ্বাস করতে পারছি না। গ্রেনেডটা বিস্ফারিত হয়নি। চট করে দাড়িয়ে আর একটা গ্রেনেড চার্জ করার জন্য যেই না এ্যমুনেশন বেল্টে হাত দিয়েছি, অমনি বিঁও করে একটা বুলেট কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। বিদ্যুৎ বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লাম রেলের দুই লাইনের মাঝে পাথরের উপর। চার হাত পায়ে যেন আগুন ধরে গেল চোখা পাথরের আঘাতে, পাত্তা দিলাম না। গড়িয়ে পেরিয়ে গেলাম দক্ষিন দিকের লাইন, কারন গুলিটা এসেছে উত্তর দিক থেকে মানে গুদাম ঘরের দিক থেকে। শুরু হয়ে গেল গুলি বৃষ্টি, ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে আমার দিকে। বেশীরভাগ গুলিই উড়ে যাচ্ছে আমার পিঠের উপর দিয়ে। কয়েকটা এসে আঘাত করছে রেল লাইনে টং টং শব্দ করে । হায় আল্লাহ, “সিটিং ডাকে” পরিনত হয়েছি আমি। মৃত্যু এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছি আমি। চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। মা, বাবা, ভাই, বোন সকলের মুখ একে একে ছায়াছবির মত ভেসে যাচ্ছে। মনে পড়ছে আমার দলের সবার কথা। ওয়ালেস ভাই, আরশাদ ভাইয়ের কথা, একসাথে ট্রেনিং নিয়েছি আমরা, ট্রেনিং এর কথা মনে পড়তেই ভেসে উঠলো দু’টো বাঘের চোখ, মেজর নাজমুল হক, আমাদের ট্রেনিং দিয়েছেন উনি। চোখ দু’টো যেন আমাকে ধমক দিয়ে বলছে, “এই স্টুপিড, হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন?” বোধ শক্তি ফিরে পেলাম, ওয়ালেস ভাইদের পক্ষে আর এগিয়ে আসা সম্ভব না, সময়ের অনেক আগেই এ্যাকশনে গিয়েছি আমরা যা করার আমাকে একাই করতে হবে। উত্তর দিকে যাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা, কারন গুলি ওদিক থেকেই আসছে, পূর্বদিকে মানে স্টেশনের দিকে, রাজাকারদের দেখে এসেছি, তাছাড়া ক্রলিং করে অতদূর যাওয়াও সম্ভব না। দক্ষিন দিকে ফাঁকা মাঠ, ত্রিশ গজ যেতে না যেতেই গুলি খাবো। বাকি থাকলো পশ্চিম দিক মানে ঘুমটি ঘরের দিক। ঘুমটি ঘরের কাছে অবিস্ফোরিত গ্রেনেডটি এখনও পড়ে আছে। গ্রেনেডটা না ফাটলেও বেশ কাজ দিয়েছে, আতঙ্কে সব রাজাকারই পালিয়েছে। ঘুমটি ঘরের ভিতর রাইফেল গুলো রয়েছে। একবার যদি ঘুমটি ঘরের ভিতর ঢুকতে পারি, তা হলে একটা ফাইট হতে পারে। কিন্তু ভেতরে যাব কিভাবে? ঘুমটি ঘর আমার থেকে প্রায় বিশ গজ দূরে, দশ গজ যেতে না যেতেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবো। তবে আশার কথা গুলি শুধু এক জায়গা থেকেই আসছে, আর সেটা হচ্ছে গুদাম ঘর। আমার অবশিষ্ট গ্রেনেডটা যদি আমি গুদাম ঘরের দিকে চার্জ করি, তাহলে হয়তো কয়েকটা সেকেন্ড পাবো। এতো কিছু চিন্তা করলাম মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। হ্যাঁ, এটাই একমাত্র পথ, এ ছাড়া কোন উপায় নেই, আমাকে যে ভাবেই হোক ঘুমটি ঘরে ঢুকতেই হবে।
পিঠটা এক চুলও উচুঁ না করে খুব সাবধানে বেল্ট থেকে গ্রেনেডটা বের করলাম, পিন টেনে খুলে, কায়মনো বাক্যে আল্লাহ’র কাছে প্রর্থনা করলাম, ইয়া আল্লাহ এই গ্রেনেডটা যেন ধোঁকা না দেয়। গ্রেনেডটা ছুঁড়তে যেয়ে দেখলাম ডান হাত দিয়ে ছুঁড়তে গেলে শরীরটা উঁচু করতে হবে। সেক্ষেত্রে গুলি খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি আর বাঁ হাতে ছুঁড়লে রিস্ক অনেক কমে যায়। সিদ্ধান্ত নিলাম বাঁ হাতে ছুঁড়বো। তবে সুবিধা এই যে, গুদাম ঘরটা বেশ নিচু জায়গায়, কাজেই গ্রেনেডটা যেখানেই পড়–ক, গড়িয়ে গুদাম ঘরের দিকে যাবে। আল্লাহ’র নাম নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম গ্রেনেডটা। এক, দুই, তিন, চার দ্রিম করে একটা বিকট শব্দ আমার কানে যেন মধু বর্ষন করলো। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাথা নিচু করে ছুটলাম ঘুমটি ঘরের দিকে, উড়ে যেয়ে পড়লাম শক্ত মেঝেতে। হাত ভাঙ্গলো কি পা ভাঙ্গলো দেখার সময় নেই, এক গড়ান দিয়ে চলে গেলাম রাইফেল গুলোর কাছে। ছোঁ মেরে তুলে নিলাম একটা রাইফেল। অভ্যাস বসত সেফটি-ক্যাচ অফ করেই বোল্ট টানলাম। একটু হলেও হতাশ হলাম, কোন গুলি নেই। ভাববার সময় নেই। বেল্ট থেকে একটা গুলি বের করেই ডাইরেক্ট চেম্বারে ঢুকিয়ে দিয়েই কক করলাম এবং সাথে সাথেই কোন নিশানা না করেই ট্রিগার টেনে দিলাম। বিকট শব্দ করে .৩০৩ র শক্তিশালী গুলি বেরিয়ে গেল।

ষষ্ঠ পর্ব


রাজাকারেরা সংখ্যায় অনেক, ওরা জানে ঘুমটি ঘরের রাইফেল গুলিতে কোন গুলি নেই, ওরা হয়তো নির্ভয়ে আমার দিকে একযোগে এগিয়ে আসতে পারে, সেক্ষেত্রে আমি বিপদে পড়ে যাব। তাই, একটা ফায়ার করে ওদেরকে জানিয়ে দিলাম, যেভাবেই হোক আমার হাতিয়ার র্নিবিষ না, গুলি এদিক থেকেও যাবে, কাজেই সামনে এগিও না। আসলেও ওরা এগিয়ে আসছিল, গুলির শব্দে তাড়াহুড়ো করে পিছিয়ে গেল। এই সুযোগে আমি ম্যাগজিন খুলে এ্যামুনেশন বেল্ট থেকে গুলিগুলো বের করে ম্যাগজিন লোড করেই রাইফেলে জুড়ে দিলাম। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে বিদ্যুৎ বেগে বল্ট টেনে রাইফেলটা লোড করে নিলাম। দরজার পাশ দিয়ে একটু উঁকি দিতেই এক ঝাঁক গুলি পেছনের দেয়ালে লেগে কিছু ইটের গুড়ো ছিটিয়ে দিল আমার চোখে মুখে, কম পক্ষে একটা গুলি এ দরজা দিয়ে ঢুকে পেছনের দরজা দিয়ে বিউ করে বেরিয়ে গেল। অনেকক্ষন ধরে একটা ব্যাপারে খটকা লাগছিল, ধরতে পারছিলাম না। এবার ধরে ফেললাম, কম পক্ষে দু’টো গুলির শব্দ .৩০৩ রাইফেলের না। “ব্লাডি চাইনিজ রাইফেল।” তার মানে ভেড়ার মাঝে বাছুর পরামানিকও আছে। তাইতো বলি শালার রাজাকারের বাচ্চাদের এতো সাহস হলো কোথা থেকে! এখন আর এসব ভেবে লাভ নেই, পর পর দু’টো গুলি পাঠিয়ে দিলাম শত্রু পক্ষ লক্ষ্য করে। মনে হলো ও পক্ষের উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়লো। এলো পাতারি কয়েকটা গুলি হলো ও পক্ষ থেকে। আমার কাছে আর মাত্র সাতটা গুলি আছে। বেশিক্ষন টিকতে পারবো না এই সামান্য পুঁজি নিয়ে, ওয়ালেস ভাইদের পক্ষেও এগিয়ে আসা সম্ভব নয় এ পরিস্থিতিতে। আমাকে যে ভাবেই হোক আমার দলের কাছে ফিরে যেতে হবে রাইফেল গুলো নিয়ে। এক সেকেন্ড ভেবে নিলাম কি করবো। আবার পর পর দু’রাউন্ড গুলি ছুঁড়েই রাইফেল চারটির স্লিং বাঁ হাতে জড়িয়ে নিলাম আর ডান হাতে নিলাম লোডেড রাইফেলটি। এক লাফে পেছনের দরজা পেরিয়েই লাইন অফ ফায়ার থেকে সরে গেলাম, তারপর ঢুকে পড়লাম পাট ক্ষেতের ভিতর। পাট ক্ষেতে এর আগেও বহুবার ঢুকেছি। আমাদেরকে প্রায়শই প্রাকৃতিক কর্মটি পাট ক্ষেতে সারতে হয়। মোটামুটি শান্তির জায়গা কিন্তু এই শান্তির জায়গাটিই যে আজ আমার কাছে এতো অশান্তির হয়ে ধরা দিবে, ভাবতেও পারিনি। পাট ক্ষেতে দৌড়ানো তো দূরের কথা, হেঁটে যাওয়াও কষ্টকর। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে যত তারাতারি সম্ভব এগিয়ে যেতে থাকলাম। শরীরের শক্তি দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর যেতেই শুরু হলো নতুন উপদ্রব, হারামীর বাচ্চারা ফায়ারিং শুরু করেছে। এলো পাতারি গুলি এদিকে সেদিকে যাচ্ছে, কাছেই কয়েকটা পাট গাছের মাথা ভেঙ্গে গেল। চিন্তায় পড়ে গেলাম, যদিও আমাকে দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু একটা গুলি শরীরে কোনভাবে বিঁধে গেলেই অচল হয়ে পড়বো। ক্রলিং করে যেতে পারলে অনেকটা রক্ষা হতো কিন্তু এ পরিস্থিতিতে কিছুতেই ক্রলিং করা সম্ভব নয়। একবার ভাবলাম ফাঁকা রাইফেল চারটা ফেলে দেই কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে কষে একটা ধমক লাগালাম। রাইফেল ছেড়ে যাওয়া চলবে না কিছুতেই। মাথাটা যতটুকু সম্ভব নিচু করে এগিয়ে যেতে থাকলাম দাঁতেদাঁত চেপে।
হঠাৎ করে ভাগ্য সহায় হয়ে উঠলো, একটা সরু আইলের উপর এসে পড়লাম। আইলটা বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে মেঠো পথের দিকে চলে গিয়েছে। চট করে লাইন পজিশনে চলে গিয়েই ক্রলিং করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। সঙ্গে রাইফেল গুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। চলার গতি অনেকটাই বেড়ে গেল, গুলি খাওয়ার সম্ভাবনাও কমে গেল। কিন্তু বেশিক্ষন এই পাট ক্ষেতে থাকা যাবে না। আমাকে মেঠো পথে উঠতে হবে। এক সময় মেঠো পথটা দৃষ্টি গোচর হলো, সামনেই বিশ পঁচিশ হাত দূরে। গুলির শব্দের বিরাম নেই, হারামীর বাচ্চারা সম্ভবত রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে ফায়ারিং প্যাকটিস করছে। সহ্যের শেষ সীমায় চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা। কিছু একটা ব্যাবস্থা করতেই হবে।
মেঠো পথটা জমি থেকে প্রায় এক দেড় হাত উঁচু। পথের পাশে পজিশন নিলে ভাল একটা আড়াল পাবো। পাট ক্ষেত থেকে বেরিয়ে চারিদিক খুব সাবধানে দেখে নিলাম, লাইন পজিশনে থেকেই। রাজাকররা আসলেই রেল লাইনের উপর দাড়িয়ে পাট ক্ষেতের দিকে ফায়ার করছে। মেঠো পথের পাশে প্রায় পাঁচ ছয় হাত ডান দিকে একটা ঝোপ দেখতে পেলাম, ডিসিশন নিলাম ঝোপটা পেরিয়ে ঝোপের আড়াল নিয়ে পজিশন নিব। খুব সাবধানে ঝোপের আড়ালে গিয়ে মেঠো পথের ঢালে পজিশন নিলাম।
আমার থেকে রাজাকারদের দুরত্ব প্রায় সোয়াশো গজের মত। ফাঁকা রাইফেল চারটা ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে লোডেড রাইয়েলটা বাগিয়ে ধরলাম শত্রুর দিকে। নিশানা করতে পারছি না, পরিশ্রমে ঘেমে নেয়ে উঠেছি, বুকটা হাপরের মত উঠা নামা করছে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম, ট্রেনিং এর কথা মনে পড়লো, লম্বা লম্বা নিশ্বাস নাও, নিশানা করো, তারপর আলতো করে টেনে দাও ট্রিগার।
শত্রুর দিকে ভালোকরে লক্ষ্য করলাম, আসলেই বাছুর পরামানিক আছে দু’জন, প্রায় কালো রং এর ইউনিফর্ম পরে আছে। বাকি বেশ কয়েকজনকে দেখলাম নরমাল ড্রেসে। পাখী মারা হাত আমার। একদম ছোট বেলায় এয়ার গান চালিয়েছি, একটু বড় হলে .২২ বোর রাইফেল, ক্লাস সেভেনে থাকতেই নানার বন্দুকে হাতে খড়ি। নানা বাড়ী খাদাসে কত ঘুঘু, বক, পানকৌড়ি, বালি হাঁস মেরেছি তার হিসাব নেই।
কালো ইউনিফর্ম একটাকে নিশানা করে টেনে দিলাম ট্রিগার, জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল .৩০৩ এর শক্তিশালী বুলেট। দুই হাত উঁচু করে পেছন দিকে পড়ে গেল কালো ইউনিফর্ম। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে বোল্ট টেনে ফাঁকা খোকাটা বের করে দিয়েই চেম্বারে পাঠিয়ে দিলাম আর একটা বুলেট এবং ফায়ার করলাম। মূহুর্তের মাঝে ফাঁকা হয়ে গেল ময়দান। আমিও আর বিলম্ব না করে রাইফেল গুলো নিয়ে ভোঁ দৌড় দিলাম উল্টো দিকে (বন্দরের দিকে)।
এঁকে বেঁকে দৌড়িয়ে ঢুকে পড়লাম বন্দরের ভিতর। দোকান পাট সব বন্ধ। রাস্তায় কোন জন প্রানীর চিহ্ন নেই। যে যে দিকে পেরেছে, পালিয়েছে কিম্বা লুকিয়েছে। কোন দিকে যাবো ঠিক বুঝতে পারছি না। মাথাটা ঠিক মত কাজ করছে না, চোখেও ঝাপসা দেখছি। হঠাৎ পেছনে একটা শব্দ পেলাম, সম্ভবত কেউ আমাকে ডেকেছে, পাঁই করে পেছনে ঘুরলাম, ঘুরতে ঘুরতেই সিটিং পজিশনে চলে গেলাম ফাঁকা রাইফেলগুলো রাস্তায় ফেলে দিয়ে। “এই এই কি করিস? গুলি করিস না, আমি ফরহাদ।” “ফরহাদ?” ঠিক মত চিনতে পারছিনা। জিজ্ঞেস করলাম, “বাবার নাম কি?” ফরহাদ সম্ভবত আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলো, ঝটপট উত্তর দিল, “অনসার আলী।” রাইফেল নামিয়ে নিলাম আমি।

সপ্তম পর্ব

দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে এলেন ওয়ালেস ভাই, পেছনে মন্ডল ভাই ও ফজলু। “রাইফেল এনেছো, ভেরি গুড, টেক রেষ্ট।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলতে বলতে ছোঁ মেরে একটা রাইফেল তুলে নিয়েই ম্যাগজিন খুলে ফেললেন। গুলি নেই দেখে দ্রুত এ্যামুনেশন বেল্ট থেকে গুলি বের করে ভরতে ভরতেই গুমটি ঘরের দিকে দৌড় দিলেন, মন্ডল ভাই, ফরহাদ ও ফজলুও একটা করে রাইফেল উঠিয়ে নিয়ে গুলি ভরতে ভরতে ওয়ালেস ভাইকে অনুসরন করলো।
কি আশ্চর্য, রান্না-বান্নার সমস্ত জিনিস যোগাড় করলাম আমি, আর উনারা চললেন আমাকে রেখে পার্টি করতে। কোনমতে রাইফেলে ভর দিয়ে উঠে পড়লাম তারপর চললাম উনাদের পেছনে পেছনে টলতে টলতে। কিছুদূর এগুতেই ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল, তারপরেই কানে এলো পর পর দু’টো গ্রেনেড বিষ্ফোরনের বিকট আওয়াজ। বেপরোয়া ভাবে আক্রমন করেছেন ওয়ালেস ভাই। কোন কিছুর পরোয়া না করে দিপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। পাগল হয়ে গিয়েছে নাকি ওরা! কোন পেশাদার দক্ষ সৈনিকের পক্ষেও আর্টিলারী সাপোর্ট ছাড়া এ ধরনের আক্রমন করা সম্ভব নয়। কি গভীর দেশ প্রেম, দৃঢ় মনোবল আর বেপরোয়া হলেই এমনি করে আক্রমন করা সম্ভব, যাদের কাছে জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন। আবার একটা গ্রেনেডের শব্দ। তীব্র আক্রমন সহ্য করতে না পেরে রনে ভঙ্গ দিল শত্রুপক্ষ। যে যে দিকে পারলো খিঁচে দৌড় দিল। বেশীর ভাগই পালিয়ে গেল গাবতলীর দিকে, সঙ্গে নিয়ে গেল আহত/নিহত সঙ্গীদের। এক লাথিতে গুদাম ঘরের একটা দরজা ভেঙ্গে ফেললেন মন্ডল ভাই, রাইফেল বাগিয়ে লাফিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন, কেও নেই, ফাঁকা। হস্তগত হলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরো চারটি .৩০৩ রাইফেল, পিঠে ঝুলিয়ে নিলাম আমরা চার জন চারটি রাইফেল ব্যাক আর্ম পজিশনে। এদিকে “জয় বাংলা” ধ্বনিতে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে ফেলছে ফজলু পাগলা ও ফরহাদ।
“এ্যাডভান্স টুওয়ার্ডস রেল স্টেশন”, বজ্র কন্ঠে কমান্ড করলেন ওয়ালেস ভাই। (প্রায় সময়ই ইংরেজীতে কথা বলেন ওয়ালেস ভাই। এতে নাকি গ্রামের লোকজন বুঝতে পারবে আমরা ছাত্র, আর সেই সময় ছাত্রদের উপর গ্রাম-বাংলায় জনগনের ছিল অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা) পাশাপাশি এক লাইনে রাইফেল বাগিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম আমরা কোন কিছুর পরোয়া না করে। “জয় বাংলা” ধ্বনিতে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলছি। রক্ত মাথায় উঠে গিয়েছে সবার। বিকট শব্দে আমাদের হাতের রাইফেল গুলো গজরাচ্ছে, গুলির অভাব নেই, এক বাক্স গুলি পেয়েছি আমরা গুদাম ঘর থেকে। বিনা বাঁধায় রেল স্টেশন দখল করে নিলাম আমরা। আনন্দে ভরে উঠলো মন। এটা আমাদের দেশ, এই রেল স্টেশনটা এদেশেরই ক্ষুদ্র একটা অংশ। আজ আমরা আমাদের দেশের ক্ষুদ্র একটা অংশ মুক্ত করলাম, হয়তো বেশক্ষিন ধরে রাখতে পারবো না কিন্তু সেদিন আর বেশী দূর নয় যেদিন আমরা সমগ্র দেশ থেকে জাঁকিয়ে বসা কুত্তার বাচ্চাদের লাথি মেরে বের করে দিব ইনশাআল্লাহ্, টুটি চেপে ধরবো হারামজাদা রাজাকার, আল-বদর আর পাকিস্তানী দালালদের।
রেল স্টেশন উডিয়ে দিতে হবে, কিন্তু, আমাদের কাছে কোন এক্সপ্লোসিভ নেই। ওয়ালেস ভাই বল্লেন, “দ্যাখোতো কোথাও কেরোসিন তেল পাও কিনা?” ফজলু পাগলাকে আদেশ করলেন ছাদে উঠে রাইফেলের বাড়ি দিয়ে সমস্ত তারগুলো ছিঁড়ে ফেলতে। হুকুম পাওয়া মাত্র ফজলু বানরের মত লাফিয়ে উঠে গেল ছাদে। ইতমধ্যে আমাদের “জয় বাংলা” ধ্বনি শুনে দু একজন করে বেশ কিছু লোকজন এসে পড়ছে স্টেশনে। একজন এসেছেন মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে, পাশে ছেলের হাতে পানির জগ আর গ্লাস। পানি দেখে আর ঠিক থাকতে পারলাম না, এক ঝটকায় ছেলেটির হাত থেকে পানির জগটা প্রায় ছিনিয়েই নিলাম তারপর জগটা সরাসরি মুখে লাগিয়ে ঢক ঢক করে প্রায় পুরোটা জগের পানি শেষ করে ফেললাম। বুকটা মনে হয় শুকিয়ে সাহারা মরুভূমি হয়ে গিয়েছিল এতোক্ষনে জুড়িয়ে গেল, সেই সাথে মাথাটাও একটু ঠান্ডা হলো। ভালো করে চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম, কি আশ্চর্য, কেউ এনেছেন ডাব, কেউ এনছেন কলা, মিষ্টির কথাতো আগেই বলেছি। কি অপূর্ব দৃশ্য। কি গভীর ভালবাসা। আনন্দে বুকটা ভরে গেল, এদের জন্যইতো আমরা যুদ্ধ করছি। হাত-পায়ের ব্যাথা মুহুর্তেই ভুলে গেলাম।
ইতিমধ্যে মুকুল এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। ও ওর দায়িত্ব ঠিক ভাবেই পালন করেছে, গ্রেনেড দু’টো ছুঁড়ে ওর পালিয়ে যাবার কথা, কিন্তু পালিয়ে না গিয়ে ও রেল লাইনের উত্তর পাশের একটা ঝোপে লুকিয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছিল, আমরা স্টেশন দখল করে নিলে ও আমাদের সাথে এসে যোগ দেয়।
এক ভদ্রলোক বল্লেন, আমার দোকানে কেরোসিন তেল আছে, নিয়ে আসছি এক্ষুনি, দ্রুত চলে গেলেন তিনি। এদিকে ওয়ালেস ভাই স্টেশন মাস্টার সাহেবের রুমে ঢুকে বের করে নিয়ে আসলেন উনার চশমা ও “কোরান শরীফ” সেই সাথে সুভেনির হিসাবে বগলদাবা করে আনলেন একটা গোল সাদা রং এর দেয়ালঘড়ি, তাতে লিখা “পাকিস্তান ইষ্টার্ন রেলওয়ে” (ঘড়িটি স্বাধীনতার পর বহু বছর ওয়ালেস ভাইয়ের বাড়ীতে যুদ্ধজয়ের প্রতিক হিসাবে শোভা বর্ধন করেছে)। এসে গেল কেরোসিন, আমরা স্টেশন মাস্টার সাহেবের রুমের সবগুলো চেয়ার টেবিল এক জায়গায় করে কেরোসিন ছিটিয়ে দিলাম, শুধু একটা চেয়ার ওয়ালেস ভাই বাহিরে এনে “কোরান শরীফ” ও চশমা চেয়ারটির উপর যতœ করে রেখে দিলেন তারপর রুমে ঢুকে দিলেন আগুন লাগিয়ে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো, আমরা সবাই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “জয় বাংলা” সাথে সাথে স্টেশনের সবাই একযোগে চিৎকার করে উঠলো, “জয় বাংলা”।
এবার ফেরার পালা। মুক্ত রেলওয়ে স্টেশনে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে যাত্রা শুরু করলাম “হাট করমজার” উদ্দেশ্যে। সবাই হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালো আমাদেরকে, আনন্দে মন ভরে উঠলো । নিজের দেশ যে কতো প্রিয়, সেটা খুব ভালোভাবে অনুধাবন করা যায় দেশের জন্য কোন একটা জয় ছিনিয়ে আনলে। ফেরার পথে দু’পাশের গাছ-পালা, ফসলের ক্ষেত, নদী-নালা, ক্রীড়ারত ছোট ছোট বাচ্চা-কাচ্চা, কলসী কাঁখে গাঁয়ের বধূ সবাইকে অতি আপন মনে হচ্ছিল। খুশিতে একসাথে সবাই হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠলাম, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি……………।”
………সমাপ্ত………..

(২৭/০৮/২০১৭ ইং)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!